বাংলা

প্রবন্ধ সংকলন “বিষয় আত্মহনন” , ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ

পূর্বকথা

ভাষাবন্ধন শিল্প-সাহিত্য-সমালোচনা  সিরিজের বিষয় আত্মহনন  গ্রন্থে আমার যে দুটি  প্রবন্ধ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এই প্রবন্ধটি তার একটি।

 

প্রাবন্ধিক : অভীক গঙ্গোপাধ্যায়

 

সিলভিয়া প্লাথ : নির্জন হাতে মৃত্যুকে অভ্যর্থনা

ষাট বছর পর লন্ডনের শীতলতম বছরগুলির মধ্যে একটি ১৯৬৩। একটি দুই বছরের মেয়ে ও আট মাসের ছেলেকে নিয়ে স্বামী টেড হিউজেসে-র সঙ্গ ছেড়ে  পাঁচ বছরের চুক্তিতে একসময়ের ইংরেজ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্‌স-এর বাসস্থানে উঠে আসেন তিরিশ বছরের কবি ও ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩)। ঘরের বাইরে যে শহর লন্ডন,তা অনেকটাই যেন সিলভিয়া প্লাথ-এর জীবনের ধূসর পাণ্ডুলিপি। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩, প্লাথ রান্নাঘরে খুব ব্যস্ত। সদ্য ছাড়িয়ে দেওয়া বাচ্চাদের আয়ার অভাবে তাদের জন্য খাবার তৈরির ব্যস্ততা নয়-সযত্নে রান্নাঘরে সমস্ত ফাঁকফোকরকে নিশ্ছিদ্র করতে, যাতে রান্নাঘর থেকে গ্যাস বেরিয়ে বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি না করে। সঙ্গে ছিল এক শিশি ঘুমের ওষুধ। তারপর গ্যাস ওভেনের সঙ্গে শক্ত করে নিজের মাথাটাকেও বেঁধে ফেলেছেন। একটা ছোট চিরকুট, ‘Call Doctor Horder’, নম্বরসহ সেই প্রতিবেশীর দরজায় রাখা ছিল। ঘুমন্ত শিশুদের ঘরেও কাপড় ও টাওয়েল দিয়ে নিশ্ছিদ্র করে দিয়েছিলেন যাতে ঘুমন্ত শিশুরা কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে না পড়ে। একটাই কাজ বাকি ছিল- গ্যাসের সুইচ ঘুরিয়ে, না ধরিয়ে তাকে চালু রাখাজীবনীকার বা সমালোচকেরা জানেন না, তার নিজের লেখা কবিতার কয়েকটি কথা ওরকম জীবনবিমুখ বিদায় বেলায় মনে এসেছিল কিনা-

            The dead bell,

                                 The dead bell.

                                          Someday’s done for.

পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের হেপটনস্টল চার্চের কবরখানায় ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩-তে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সেখানে লেখা তাঁর নাম সিলভিয়া   প্লাথ হিউজেস থেকে হিউজেস শব্দটি বাদ দিয়ে দেওয়া হলেও, সিলভিয়া প্লাথ-এর জীবনকে নয়, তাঁর রচনাকে ধরা যায় এমন একটি কবিতার লাইন আজও রয়ে গেছে :

“Even amidst fierce flames-the golden lotus can’t be planted.”

সাধারণভাবে প্লাথের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ১৯৬২ সালের গ্রীষ্মকালে স্বামী ও কবি টেড হিউজেস-এর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া ও আসিয়া ওয়েভিল-এর সঙ্গে টেড হিউজেসের অবৈধ সম্পর্ককে উল্লেখ করা হয়।তাৎক্ষণিক উদ্দীপক যতই তীক্ষ্ণ হোক না কেন, যেখানে প্লাথ-এর ‘volcanic passion’-এর একটা পথ আত্মহনন দেখিয়েছিল-অতীত ও সেই অতীতের ভাবনার ছায়া তাঁর বর্তমানকে কখনোই আলোকিত হতে দেয়নি। কুড়ি বছর বয়সে, অগাস্ট ২৪, ১৯৫৩, মার আলমারি থেকে,তাঁরই জন্য রাখা সব ঘুমের ওষুধ একসঙ্গে খেয়ে ফেলেছেন। অনেক দূরে হাঁটতে যাচ্ছেন, এই মর্মে একটা চিঠি লিখে, তাঁদের বাড়ির বেসমেন্টের ঘরে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। কোমা অবস্থায় গোঙানির শব্দ শুনে, উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে রেখে বাঁচানো হয়। ১৯৬২-তে টেড-এর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরপরই, গ্রীষ্মকালে, প্লাথ একটি পরিত্যক্ত বিমানবন্দরে নিজেরই গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে গাড়িটিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে চালিয়ে রাখেন, কিন্তু সেবার তিনি বেঁচে যান।

তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্য বেল জার’ এবং ‘এরিয়ল’ কাব্যসংগ্রহ নতুন করে লেখকের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। মৃত্যুর উনত্রিশ দিন আগে ‘দ্য বেল জার’ উপন্যাসটির উদ্বোধন হলেও, তখন অপ্রত্যাশিত ভাবেই আমেরিকার পত্র পত্রিকায় বিরূপ সমালোচনাই বেরিয়েছিল। জানুয়ারির শেষাশেষি তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর বিষন্নতা খুব স্বল্পস্থায়ী কোন ক্লান্তিকর বেদনার ঘোর নয়। ডক্টর হোরডার কে জানালে, তিনি মানসিক অবসাদের ওষুধ, একজন মনস্তাত্ত্বিকের পরামর্শ এবং হাসপাতালে তাঁর জন্য একটি শয্যার ব্যবস্থাও করে দেন, এও জানা যায় যে ৭ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগেও তাঁর বন্ধু জিলিয়ন বেকর-এর সঙ্গেই সর্বক্ষণ থাকেন, কারণ তখন শুধু ওষুধ তাঁর ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারছিল না। বন্ধুর সঙ্গে যতক্ষণ ছিলেন তক্ষণই টেডের প্রতি তীব্র ঘৃণা, তাঁর বিশ্বাসের চূড়ান্তভাবে অপমানিত হওয়ার যন্ত্রণা গুমরে গুমরে প্রকাশ পেয়েছিল। মৃত্যুর একদিন আগে রবিবার ১০ ফেব্রুয়ারি প্লাথ নিজের বাড়ি ফিরে আসেন, জানান তিনি ভালো বোধ করছেন। ডক্টর হোরডার পরের দিন সকাল ৯ টা থেকে একজন নার্সের ব্যবস্থা করে দেন এবং এক প্রকাশকের সঙ্গে দুপুরে একসঙ্গে খাবার পরিকল্পনা স্থির হয়বাড়ি ফেরার পুরো পথটাই প্লাথ এতই কাঁদছিলেন যে বেকর পরিবার তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। যদিও প্লাথ রাজি হননি। রবিবার মাঝরাতে তাঁর নিচের তলায় প্রতিবেশী প্রফেসর টমাস-এর কাছ থেকে স্ট্যাম্প কিনে নিয়ে আসেন। প্রফেসর টমাস সারারাত ওপরে নড়াচড়া ও পায়চারির শব্দ পান।    

সোমবার ১১ই ফেব্রুয়ারি, সকাল ৯ টা নার্স এসে পৌঁছেছে দরজা বন্ধ, কোনো সাড়া নেই। দরজা ভেঙ্গে ঢুকে, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস প্রশ্বাস ফেরাবার বৃথা চেষ্টা কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। উপরের তলায় ঐ ঠাণ্ডায় বাচ্চাদের ঘরের জানলা খোলা, সামনে পাউরুটি ও দুধ প্লাথের রেখে যাওয়া। আর বাচ্চা দুটির থামানো যায়না এমন কান্না। চল্লিশটির বেশি কবিতা নিয়ে যে ‘এরিয়ল’ গ্রন্থ, সমালোচকদের মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি, সেখানে ‘ড্যাডি’ ও ‘লেডি ল্যাজারস’ কবিতা দুটির মধ্যে প্লাথের ক্রমশ ভঙ্গুর মানসিক অবস্থার অনুষঙ্গ ধরা যায়। ‘ড্যাডি’ কবিতায় প্রায় শুরুতেই, প্লাথ লিখছেন-‘বাবা,তোমাকে না মেরে আমার উপায় ছিল না’। এই কবিতারই আরও পঞ্চাশ লাইন পর আবেগের তীক্ষ্ণ ফলাকা পাঠককে বিদ্ধ করবেইঃ

       আমি দশ বছরের ছিলাম যখন তোমায় কবর দেয়

       কুড়িতে শেষ হতে চেয়েছিলাম

       ফিরে যাবার, তোমার কাছে ফিরে যাবার জন্য...

ক্ষোভ যখন এই ভাবনাকে প্রায় রক্তক্ষরণের জায়গায় নিয়ে যায় তখন কবিতা হয়ে ওঠে আরও নির্মম স্বীকারোক্তি :

       যদি আমি একজনকে মেরে থাকি, তাহলে আরেকজনকেও,

       মেরেছি যে রক্তচোষা বলেছিল, সেই

       এক বছর ধরে পান করেছিল আমার রক্ত...

       সাত বছর, যদি জানতে চাও...

১২ই অক্টোবর ১৯৬২ তে লেখা এই কবিতাটি ১৯৬৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ‘এরিয়ল’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। এই কবিতার তাৎপর্য ও বিষয়বস্তুর প্রকৃতি নিয়ে সমালোচকদের বিশ্লেষণের বিভিন্নতা চোখে পড়বার মত। বলিষ্ঠ শব্দচিত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘হলোকস্ট’-এর বিতর্কিত রূপক এই কবিতার আরেকটি কারণ। ‘ড্যাডি’ শব্দটির ব্যবহার অনেক সমালোচকদের প্লাথের সঙ্গে তাঁর বাবা অটোপ্লাথ-এর জটিল সম্পর্কের এক প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখে। যদিও প্লাথের আট বছরের জন্মদিনের ঠিক পরপরই ডায়াবেটিসে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। অনেকটা নার্সারি রাইমের আপাত সারল্য এই ‘ড্যাডি’ কবিতার গঠন ও রচনাশৈলীতে চোখে পড়ে। হতাশাকে খুব সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করা তাঁর রীতি ছিল না। হয়তো আমেরিকার সাহিত্যিকদের রচনাশৈলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এটা চোখে পড়বার মতো। ‘তিরিশ বছর ধরে একটা কালো জুতোর মধ্যে থেকে যাওয়া একটা পায়ের মতো একটা জীবন’- এই স্বীকারোক্তি কৃত্রিম চমক নয়, এক যন্ত্রণাবিদ্ধ, তীক্ষ্ণ অনুভূতিসচেতন এক মনের এক অকপট হাহাকার, নগ্ন কিন্তু একতাল শরীরী মাংস নয়।আত্মহত্যার কিছুদিন আগে, বিবিসি রেডিওতে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে তাঁর এই কবিতাটির সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করাতে গিয়ে বলেছিলেন, এই কবিতার বিষয় একটি মেয়ে, যার মধ্যে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স রয়েছে। যে তার বাবা মারা যাওয়ার সময়েও, বাবাকে ভগবান বলে ভাবত কিন্তু যে বিষণ্ণ শব্দচিত্র এই কবিতায় সরব, যে শিশুসুলভ কথনে ও সারল্যে এই তীব্র বেদনা প্রকাশিত, সেখানে বাবা ও মেয়ের মধ্যে কোনো এক অসচরাচর সম্পর্কেরই ইঙ্গিত দেয়। এক অসহিষ্ণু চূড়ান্ত ভৎ‍সনায় কবিতাটির শেষ লাইন জ্বলে ওঠে :

                           Daddy, daddy, you bastard

          I’m through.

সাধারণত আলোচকেরা এই কবিতাকে বাবার স্মৃতির সঙ্গে গভীর এক বন্ধন এবং এই বন্ধন থেকে যে বেদনার নেশা তাকে গ্রাস করেছিল, তারই অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনেকে বাবার মৃত্যুকে না মেনে নিতে পারার অক্ষমতা থেকে যে মানসিক অসহায়তা তৈরি হয়, প্লাথের কবিতার মধ্যে, বিশেষত এই ‘ড্যাডি’ কবিতাটি, তারই একটি প্রকাশ বলে মনে করেন তবে কবিতার মধ্যে যে সাত বছরের উল্লেখ রয়েছে তা আলোচনার ক্ষেত্রকে আরো প্রশস্ত করে। তার সাত বছরের বিবাহিত জীবনের যে পরিণতি স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে ধুলোয় মিশেছে, এই কবিতায় তার প্রতিবাদ কবির কলম দিয়ে রক্ত হয়ে ঝরে পড়েছে। তবে পুরো কবিতাটিতে কবি একটি মেয়ের বাবা ও স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক কে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। একটা নাৎসী ও ইহুদীর মধ্যে সম্পর্কের চালচিত্রের মধ্যে দিয়ে- কোথায় যেন একটা অত্যাচার ও অত্যাচারিত, এই সংঘাতের, প্রচ্ছায়া চেনা খুব কঠিন নয়।

                                                                                     

একদিকে ‘দ্য কলোসাস’ কবিতার ‘massive fallen statue’ চিত্রটির মধ্যেও, নিজের বাবা জীবনের প্রথম পুরুষ, তাকে ঘিরে যে শক্তিশালী রহস্যময় এক আকর্ষণের বাস্তব স্বপ্নভঙ্গ প্রকাশিত, অন্যদিকে কোথাও এক অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের স্মৃতি না থাকলে, ‘ড্যাডি’ কবিতার বারো নম্বর স্তবকে এই সাবলীল অথচ তীব্র ভাবনার ঢেউ সচেতন মনে এত জোরে আছড়ে পড়ে না...

          At twenty I tried to die

                          And get back, back, back to you

                           I thought even the bones would do….

এখানে ঘুমের ওষুধের সাহায্য নিয়ে আত্মহননের প্রচেষ্টার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। মৃত্যুতে বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি কোনো রকম অস্পষ্টতা ছাড়াই প্রকাশ পাচ্ছে। ১৩-১৪ নম্বর স্তবকে এই ভাবনারই আরেকটি মাত্রা যুক্ত হয় :

          But they pulled me out of the sack,

          And they stuck me together with glue.

          And then I knew what to do.

          I made a model of you,

          A man in black with a Meinkampf look

          And a love of the rack and the screw

          And I said I do, I do.

ওখানে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো পছন্দের পোশাক পরিহিত তার স্বামী টেড হিউজেসকে, যার থেকে সবেমাত্র কবি দূরে সরেছেন, চিনতে অসুবিধে হয় না। তীক্ষ্ণ অনুভূতি সচেতন কবি নিজেকে খুব ভালো করে চিনতেন বলেই, তাঁর মধ্যে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স-এর জন্যেই  যে টেড হিউজেসের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, নিজের কাছে সেই ব্যাখ্যা তার স্পষ্ট ছিল। টেড হিউজেস তাঁর বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, তাই প্লাথ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, আর তার ভয়াবহ পরিণতি, তাঁর এই কবিতার ১৫ নং স্তবকে :

            If I’ve killed one man, I’ve killed two—

                               The vampire who said he was you

                               And drank my blood for a year,

                               Seven years, if you want to know.

                               Daddy, you can lie back now.

দুজন পুরুষের এখানে অবশ্যই একজন বাবা, আরেকজন হিউজেস। ‘killed’ ও ‘I am finally through’ এই দুটি প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে একদিকে বাবার স্মৃতি থেকে এবং অন্যদিকে ‘vampire’-এর সঙ্গে সাত বছরের বিবাহিত জীবনের শৃঙ্খলামুক্ত হবার দাবী থাকলেও, প্লাথ যন্ত্রণাবিদ্ধ পড়ে থাকা পাখির মতো যে কোনো পথেই স্বাধীন শিল্পী জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছেন না, তা শুধু আত্মহননে ‘দুদণ্ড শান্তি’র খোঁজে নিবিড় হতে চাইছিল, এই মৃত্যু-ইচ্ছা, এই জীবনবিমুখতার দ্যুতি তার চোখধাঁধানো শব্দচয়নের মধ্যেই স্পষ্ট।

                                                           

 

ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রত্যাখানে ‘ড্যাডি’ কবিতার একটি মৌলিক দিক এবং এখানেও জীবনবিমুখ ব্যক্তি যেভাবে বেঁচে থাকার আশ্বাস খুঁজে নেয়, ভগবান ও শয়তান, এই দুই ধারণার উত্থাপন ও অবলুপ্তি ঘটিয়ে, আশ্রমের পথ বৌদ্ধিক দিক থেকে প্লাথ বন্ধ করে দেন। জীবনের উৎস থেকে তার সৃজনের ধারা এক অনিবার্যতায় পরিণামমুখী ছিল। আত্মহত্যা তাঁর কাছে সাধারণ escapism বা পলায়ন মনোবৃত্তির পরিচায়ক নয়। আত্মহনন এক অনিবার্যতা, যা প্লাথকে গ্রাস করেনি। প্লাথ নিজে যে পথে হেঁটেছেন তাঁর গন্তব্যে পৌঁছতে, তাঁকেই চেষ্টা করে এগিয়ে যেতে হবে, এ তিনি বুঝেছিলেন। মৃত্যু তাঁর ব্যক্তি ও নারী সত্তার respite  ছিল, এত সাধারণীকরণ করা উচিত নয়।

আরেকটি কবিতা, ‘লেডি ল্যাজারস’, যদিও রচনাশৈলীর জন্য বিখ্যাত, বিষয়বস্তুতে নাৎসি জার্মানির, সর্বগ্রাসী রূপকল্পে, জীবন, মৃত্যু, দুর্ঘটনা, না- চাওয়া, পুনর্জন্ম ও ডাক্তারদের উল্লেখ কবিতাটিকে, ‘a kind of mid-life death cry’ রূপে চিহ্নিত করে। উপমা উৎপ্রেক্ষায় কবিতাটি বিয়োগপ্রাপ্ত হবার যথার্থ উপাদানে সমৃদ্ধ :

           আবার আমি করেছি

           প্রতি দশ বছরে একবার

           সামলে নিয়েছি-

            যেন এক চলমান অস্বাভাবিকতা

            নাৎসি ল্যাম্পশেডের মতো উজ্জ্বল আমার চামড়া

            আমার ডান পা একটা পেপার ওয়েট

            ইহুদিদের মসৃণ কাপড়ের সুতোর মতো

            বৈশিষ্ট্যহীন আমার মুখ

            কাপড় টেনে ছিঁড়ে আমার শত্রু...

            আমাকে ভয় করছে?-

            না, চোখ, দাঁত?

            ঝাঁঝালো টক নিশ্বাস একদিন হারিয়ে যাবে।

            শিগগিরই কবরের গুহা মাংস খেয়ে

            ঘরের মতো সব স্বাভাবিক করে দেবে,

            আর আমি, যে নারী এখনও হাসে

            আমার বয়স মাত্র তিরিশ...

তার মৃত্যুর পর এই কবিতা ‘এরিয়ল’ গ্রন্থে প্রকাশিত হলেও, তার পঠিত এক রেকর্ডিংয়ে এই কবিতার অনেক লাইন অনেকেরই স্মৃতিতে ছিল, তা পরে আর কবিতাটিতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। লাইনগুলি প্লাথ নিজে বাদ দিয়েছিলেন কেনো  জানা যায় না। তিন চরণের এক একটি স্তবক যে বিষয়বস্তুকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, তা হল, যে মৃত্যুর মুখ থেকে, সে ডাক্তারই হোক আর কোনো মানুষই হোক, এরপর আর তাকে কেউ ফেরাতে পারবে না।

 

উপন্যাস ‘দ্য বেল জার’ তাঁর শিল্পী ও জীবনের বাস্তবের এক সফল রূপায়ণ। কেন্দ্রীয় চরিত্রের মানসিক ভারসাম্যহীনতা, মনোবৈজ্ঞানিকের সঙ্গে অসুস্থতা নির্ণয়ের কষ্টকর মুহূর্ত, ECT-র প্রয়োগ(শক থেরাপি), মানসিক অবসাদ থেকে দমবন্ধ করা পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম, যেমন তেমন ভাবে একাধিক আত্মহত্যার প্রয়াস, বহু হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা শেষে এক বন্ধুর আত্মহত্যার ঘটনার পর, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার মুহূর্তে এসথারের এক মৃত্যুচেতনার উদ্ভাসন, উপন্যাসটিকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের তকমা থেকে বার করে আনে।

কয়েকটি কবিতার লাইন তার পরিণামমুখী চেতনার মধ্যে যে দ্বিধা তৈরি করতে পারে না, তা প্রকাশ করে :

     I know the bottom, she says. I know it with my great top root:

              It is what you fear:

              I do not fear it: I have been there. [ Elm, 1-3]

              Its shaky acids kiss.

              It petrifies the will. These are the isolate, show faults

              That kill, that kill, that kill. [Elm,40-42]

               Every woman adores a Fascist,

               The boot in the face, the brute

               Brute heart of a brute like you. [Encounter]

১৯৬০ সালে লেখা ‘টিউলিপ’ কবিতায় হাসপাতালে সেরে উঠেছেন এমন এক বক্তার কথায় শোনা যায়ঃ

       My body is to them

                   They bring me numbness

                  Now I have lost myself

                   I am sick of baggage. [Tulip]

জীবনকে আর না-চাওয়া অলংকারে ঢাকা পড়ে না :

       I have let things slip,

                   A thirty-year old cargo boat

                     Stubbornly hanging on to my name and address [Tulip]

মৃত্যুর মধ্যে নিশ্চিত নিশ্চিন্ততা মনকে মুহূর্তের  জন্য হলেও শান্ত হতে দেখা যায় :

        I am a nun now, I have never been so pure.

                     I didn’t want any flowers, I only wanted

                     To lie with my hands turned up and be utterly empty. [Tulip]

এই চাওয়াই তাঁর শেষ চাওয়া, তাঁর চালিকাশক্তি :

        How free it is

                      The peacefulness is so big it dazes you…

                      Between the eye of the sun and the eyes of the tulips

                      The vivid tulips eat my oxygen.[Tulip]

তার মতে :

        Dying

        Is an art, like everything else

        I do it exceptionally well

        I do it so it feels real. [Lady Lazarus]

পাঠকদের স্বীকৃতি থাকলেও নির্মম সমালোচকদের দ্বারা নির্বাসিত, অন্ধকার হতাশা, নৈরাশ্যের অন্ধকার, অবশ করে দেওয়া আঘাত, জীবনের মধ্যেই যে মৃত্যুযন্ত্রণা, তা সিলভিয়া প্লাথের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল কোনো বিপরীত মেরু না দেখার ক্ষমতা। অত্যাধিক মন-সচেতন, মনস্তাত্বিক প্রকরণ সম্পর্কে অবগত হলেও, দস্তয়েভস্কি-র উপন্যাসে দ্বৈত সত্ত্বার চরিত্রের ওপর গবেষণা পত্রের লেখক হয়েও, তার নিজের মনের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারেননি। তাই এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা করেছেন মৃত্যুকে। চূড়ান্ত আনন্দ ও হতাশার মুহূর্তেও তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে না জেনেও আত্যন্তিক ভাবে মনস্তাত্ত্বিক। কল্পনার তীব্রতা, নিজেকে ব্যবহার করার ক্ষমতা, লেখার মধ্যে আত্মহনন, আত্মপ্রবঞ্চনা, তীব্রভাবে নিজেকে চাওয়া, নাৎসী চেতনার সর্বগ্রাসী ভয়াবহতা, বৈদ্যুতিক শক চিকিৎসা, ভঙ্গুর মানবিক সম্পর্ক, মানব বিধ্বংসী অস্ত্র-এই ধরণের যন্ত্রণা-তাড়িত বিষয়ের ভিড় তাঁর লেখাকে স্নিগ্ধ হতে দেয় না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সংযত শব্দচিত্রের প্রবাহ মানব মনের যন্ত্রণা জ্বালা পাঠককে অনুভব করায়। অনিয়মিত দৃশ্যবিন্যাস, অভিজ্ঞতার অস্থিরতা, রসিকতার মধ্যে এক নির্মম বীভৎসতা তাঁর সাহিত্য ও জীবনদৃষ্টিকে ‘graphically  macabre’ ও ‘surreal’ করে তোলে।

সিলভিয়া প্লাথের আত্মহননের ছয় বছর পর আসিয়া ওয়েভিল, যে নারীর জন্য তাঁর স্বামী টেড হিউজেস তাঁকে ছাড়েন, দু বছরের কন্যাসহ আত্মহত্যা করে। আশ্চর্য, সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর, ২০০৩ সালে ৪৭ বছর বয়স্ক তার ছেলে নিকোলাস হিউজেস গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আত্মহনন পরিবেশের বা পারিপার্শ্বিক জটিলতার পরিণাম, না এক পারিবারিক উত্তরাধিকার, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকদের এই বিতর্কের বাইরেও সিলভিয়া প্লাথের জীবন ও মৃত্যু, প্রেম ও ঘৃণা, যন্ত্রণা ও নৈরাশ্য, সৃষ্টি ও স্বীকারোক্তি তাঁর প্রতিভাকে ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক দুটি ধারার মধ্যেই প্রবাহিত রাখে। আত্মহননের এক সপ্তাহ আগে সিলভিয়া প্লাথের শেষ কবিতা ‘Edge’ কবিতার প্রথম তিন লাইনে যেন অ্যারিস্ততলের ‘Crystalline wisdom distilled from suffering’ ভাবনারই প্রতিধনি :

           The woman is preferred

                              Her dead

                  Body wears the smile of accomplishment.

 

তথ্যসূত্রঃ

The Collected Poems, Sylvia Plath, Harper Collins, 1981

The  Penguin Book of Poetry, 1984

Confessional Poetry, Lowell and Snodgrass

The Last Days of Sylvia Plath, J. Becker

কবিতার বঙ্গানুবাদ বর্তমান প্রাবন্ধিকের।