বাংলা

প্রবন্ধ সংকলন "আলোর মিছিল", ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ

পূর্বকথা

ছোটবেলায় যে সব সাহিত্যিকদের কথা বাবার ( অধ্যাপক ও কথাশিল্পী মানব গঙ্গোপাধ্যায়) কাছে  শুনেই খুব ভালো লেগেছিল, কামু তাদের অন্যতম। এই প্রবন্ধের মূল কাঠামোটি ১৯৮৭ সালে আমার ১০ মিনিটের বেতার কথিকা “বিশ্ব সাহিত্যের লেখকেরা, অলবে কামু”, এই সময়ে লেখা। কামুকে নিয়ে আমি অনেক জায়গায় লিখেছি, বক্তৃতাও দিয়েছি। ভাষাবন্ধন শিল্প-সাহিত্য-সমালোচনা সিরিজের আলোর মিছিল গ্রন্থে এই প্রবন্ধটি ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রবন্ধ সংকলন  : "আলোর মিছিল"

অলবে কামু

প্রাবন্ধিক :  অভীক গঙ্গোপাধ্যায়

বিশ্বসাহিত্যে মানবাত্মার গভীরতর আর্তি ও চিরকালের পিপাসা রূপ পায় বলেই  তা সর্বজনীন ও সর্বকালীন। বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধরত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে কৃত্রিম আইন ও প্রথার বিরুদ্ধে মানুষের আত্মবিকাশের জন্য আকুতি ও মৃত্যুর উৎকণ্ঠায় দুর্গত মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা ফরাসি সাহিত্যিক অলবে কামু-র মধ্যে দিয়ে এক শাশ্বত রূপ লাভ করেছে। দার্শনিক কিরকেগার্ড (Soren Kierkeggard, 1813-1855), নীৎসে (Nietzsche, 1844-1900),  বা হেইডগার(Martin Heidegger, 1889-1976) যেমন নিজেদের অস্তিত্ববাদী বলে চিহ্নিত করতে চাইতেন না, ‘আপনি কি অস্তিত্ববাদী’ এই প্রশ্নের উত্তরে কামুও সরবে জানাতেন ‘No, I am not an existentialist’;  ক্লান্তিহীন প্রতিবাদে মুছে দিতে চাইতেন ‘a philosopher of the absurd’ তকমাটি। ১৯৪৫ সালে জাঁনিয়ে দেল্‌পে-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কামু তাঁর ১৯৪৩ সালে একমাত্র তাত্ত্বিক প্রকাশনা ‘লা মেয়ে দ্য সিসিফে’-কে (দ্য মিথ অফ সিসিফাস,ইং অনুবাদ ১৯৫৫) তথাকথিত অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের বিরোধিতা হিসাবেই প্রচারিত হতে দিতে চেয়েছিলেন। বিশিষ্ট গবেষক ডেভিড ই. কুপার, তার ‘এক্সসটেনসিয়ালিজম্‌’( ব্ল্যাক ওয়েল ১৯৯০,১৯৯৯) গ্রন্থে লিখছেন ; “....একজন লেখককে যদিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, অলবে কামু, তিনি ঠিক এই তালিকাভুক্ত (অস্তিত্ববাদী) নন। তার কারণ কামু অস্তিত্ববাদী লেখকদের মত বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে উত্তরণের চেষ্টা বা পরিত্রাণের চেষ্টা করেননি। ‘দ্য আউটসাইডার’-এ মরঁস-র দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতা বোধের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদের আনন্দ সোচ্চার। কামুর ‘অ্যাবসার্ড হিরো’, সিসিফাস এক ‘নীরব সুখ’ অনুভব করেন এমন একটা জগতের, যেখানে তিনি পরিত্রাণহীন নির্বাসনের নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন।“ 

মরলা পন্তির বিখ্যাত উক্তি-‘ জগতটা সম্পূর্ণই আমার বাইরে, আর আমি সম্পূর্ণই আমার মধ্যে।- কামু সচেতনভাবে এই ভাবনার পরিবর্তনের পথে ছিলেন। অস্তিত্ববাদ ও ‘অ্যাবসার্ড’-ধারণার মধ্যে যে দার্শনিক বিস্ময় দার্শনিক দেকার্তে-র (১৫৯৬-১৬৫০) সমসাময়িক ফরাসি গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক পাসকাল (১৬২৩-৬২) চিহ্নিত করেছিলেন, তা অস্তিত্ববাদের যোগ্য পূর্ব কথা জেনেও কামু জীবনের অতিরিক্ত কোনো কিছুকে সম্বল করতে চাননি। পাসকাল বলেছিলেন, “ যখন আমি এই সংক্ষিপ্ত জীবনের কথা ভাবি যা অন্তহীন অতীত ও ভবিষ্যতের গহবরে নিমজ্জিত, আর দেখতেও পাই অসীম অবাধ ব্যাপ্তির মাঝে যেটুকু জায়গা জুড়ে আমি থাকি, যার সম্পর্কে আমি অজ্ঞ, যে অসীম আমাকেও জানেনা, চেনেনা- তখন বিহ্বল বিস্ময়ে মনে হয়, কেন এখানে, কেন আমি অন্য কোনোখানে নয়, কেন এখন, অন্য কোনো সময় নয়?” জীবনকে জীবনের ফ্রেমে দেখবার কামুর দুর্লভ ক্ষমতা আমাদের তাঁর কাফে দ্য ফ্লরে-তে প্রবেশ অধিকার দেবে।

 

দু ধরণের চিন্তা-শৃঙখলাকে কামু প্রশ্রয় দিতেন, একটি বৌদ্ধিক অপরটি শৈল্পিক। হয়ত এত সাধারণীকরণ দুর্বোধ্যতাকে ব্যাপ্ত করবে। বলা যায় জগত ও জীবনের রহস্য উন্মোচনেই দার্শনিক মনীষা যুগ যুগ ধরে যে চিন্তা প্রণালী অনুসরণ করেছিল অ্যালজিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন কামু সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত চিন্তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। কিন্তু জগৎ ও জীবনের রহস্য সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস পরিত্যাগ করে তিনি নতুন অন্বেষণে জাগ্রত হয়ে ওঠেন। সেইসঙ্গে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে, শব্দ ও কথনের সাহায্যে যে সৌন্দর্য বাস্তব হয়ে ওঠে, সেই ‘কনক্রিট বিউটি’ তাঁর শিল্পসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। একইসঙ্গে কামুর মধ্যে ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট থিংকিং’ ও ‘কনক্রিট বিউটি’র প্রতি অভীপ্সা লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে তাঁর এই দুই প্রেরণাই এক মৌলিক, বাস্তবসম্মত জীবনজিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এই জিজ্ঞাসা অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের, জীবন ও মৃত্যুর, জীবন ও জগতের মধ্যে চূড়ান্ত অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-যে প্রতিবাদ মাত্রায় বৌদ্ধিক ও দার্শনিক, কিন্তু ব্যক্তিমনের মানবিক অনুভূতি ও অনুভূতিহীনতার প্রেমে বাঁধানো। আত্মকথনে এক দুর্লভ সত্যের স্বীকারোক্তি তাঁর উপন্যাসে, নাটকে ও প্রবন্ধে-তাঁর নিজের কথায় বললে, “A guilty conscience needs to confess- a work of art is a confession”    

দার্শনিক দেকার্তের(Descartes,1596-1650) I think, therefore  I am”, ফ্রয়েডের(Freud , 1856-1939) I suffer, therefore, I am”, কামুর চেতনায় বিবর্তিত হয়েছে “I rebel, therefore, I am”,-এখানে অস্তিত্ব ও বিদ্রোহ এক অস্থির অন্তরঙ্গতায় আবদ্ধ। এই অস্থিরতা চিহ্নিত করা খুব কঠিন নয়। ১৯১৩ সালের ৭ নভেম্বর( মতান্তরে ৮) অ্যালজেরিয়ার মান্দোভিতে জন্মের এক বছরের মধ্যে কামু তাঁর বাবাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারিয়ে, একমাত্র সঙ্গী, পরিচারিকা মা-র সঙ্গে দারিদ্র নিপীড়িত সংসারে শুধু শিক্ষাকে সম্বল করে পরিবেশের সঙ্কীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পান। কখনো তাঁর প্রয়াস ছিল প্রবৃত্তিগত, কখনো বৌদ্ধিক। অ্যালসেডিয়ান বংশোদ্ভূত বাবা ও স্পেনীয় বংশোদ্ভূত মা-র এক মিশ্র মূল্যবোধের সংসার তাঁর মধ্যে প্রাথমিক বিপ্রতীকতার অনুভূতি(সেন্স অফ কন্ট্রাডিকশন) তৈরি করেছিল। ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালজেরিয়ার্স-এর দর্শনের ছাত্র থাকাকালীন দার্শনিক জাঁ গ্রেনিয়ে-র সান্নিধ্য আস্তে আস্তে তাঁকে সাহিত্য ও দর্শনের দিকে আগ্রহী করে তোলে। দুর্ভাগ্যবশত এই সময় তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সচেতনভাবে লেখকের জীবন বেছে নেবার আগে, যদিও তাঁর শিক্ষকতা করারই ইচ্ছা ছিল, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫, খুবই অল্প মাইনেতে কখনো সেলসম্যান, কখনো পুলিশ ক্লার্করূপে তিনি কাজ করেছেন। দুটি বিষয় কামুর শৈশব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, অ্যালজেরিয়ার শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে শৈশব অতিবাহিত হবার ফলে, সামাজিক সুবিচারের প্রতি, সাধারণ নৈতিক বিধির প্রতি, বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ এবং চরম নিয়তিবাদের প্রতি এক অকুণ্ঠ আকর্ষণ দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, পরপর কয়েকটি ঘটনা তাঁর মধ্যে কতগুলো কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়; বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান ও ছেড়ে যাওয়া, ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় কম্যুনিস্ট যোগদান অথচ ‘মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট’ তত্ত্বে আস্থা না রেখে তীক্ষ্ণ সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া, অ্যালজেরিয়ার শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের বৈষয়িক মোকাবিলা করা, ১৯৩৪ সালে বড়লোক পিতা-মাতার মাদকাসক্ত কন্যা সিমোয়ে হিয়ার সঙ্গে বিবাহ ও বিবাহ পরবর্তী জটিল দাম্পত্য জীবনের অবসান, যক্ষ্মার তীব্র আক্রমণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা বন্ধ হওয়া। স্যানেটোরিয়ামে থাকাকালীন জীবনের স্বরূপ মৃত্যুর পটভূমিকায় তাঁর কাছে এক নতুন রূপ নিয়ে দেখা দেয়। ফলে যুদ্ধরত পৃথিবীতে, যুদ্ধবিদ্ধস্ত পৃথিবীতে এবং স্যানেটোরিয়ামের  আশেপাশে কামুর মৃত্যুচেতনা এক বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে। মৃত্যুর ফ্রেমে আঁটা এই জীবন, জীবনের স্বরূপ ও জীবন- উপলব্ধি কামুর কাছে এক নিজস্ব উপলব্ধিতে এসে দাঁড়ায়। যেহেতু মৃত্যুর পরে কোনো পারলৌকিক অস্তিত্ব, ঐশ্বরিক চেতনা বা জীবনের কেন্দ্রে ও শিল্পের কেন্দ্রে কোনো সার্বভৌম সত্ত্বাকে কামু বিশ্বাস করতেন না, সেজন্য মৃত্যুর সাগরে ঘেরা প্রতিটি দ্বীপই অতি মূল্যবান, তা প্রেয় ও শ্রেয়। এই বোধ কামুর একাধারে মৃত্যুচেতনা ও জীবনচেতনা। এই নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদীর কাছে জীবননিষ্ঠা এক অনিবার্যতা। জীবনের প্রতি কাঙালপনা নয়, দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষের মধ্যে জীবনের মূল্য নিহিত। সেইজন্য স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনের বিকাশই কামুর কাম্য ছিল। অথচ কামুর জগতে নাৎসিবাদের তান্ডব, শোষণ, দারিদ্র, স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রভাব, সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের লোলজিহ্বা যেন ডেমেক্লিসের  খড়গের মত মানুষের অস্তিত্ব বিকাশের প্রতিটি মুহূর্তে ঝুলে রয়েছে। তাই কামুর মধ্যে প্রকাশ এক বিচ্ছিন্নতা বোধ। এই যন্ত্রণাবিদ্ধ যুগে জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে কামুর  নিজেকে শুধু মনে হয়নি যে তিনি আগুন্তুক বরং সংস্কৃতিকে দেখার, বোঝবার নিজস্ব এক দান্দ্বিক চেতনাও তার মধ্যে তৈরি হয়ে যায়-‘Culture : the cry of men in the face of their destinyএ কোনো জীবন- বিমুখ নিয়তিবাদ নয়, তাহলে কামু বলতেন না ‘Blessed are the hearts that can bend; they shall never be broken:, বা ‘Don’t wait for the last judgement-it takes place everyday’ নিজেকে এই জগতের কাছে অপরিচিত মনে হয়েছে, মনে হয়েছে অজানা, কিন্তু অস্তিত্বকে কখনই অস্বীকার করে নয়, ‘Being’-এর অন্বেষণে তখনও জাঁ পল সার্ত্রের  অস্তিত্ববাদী শূন্যবাদ, existential ‘nothingness’-এ কামু তত্ত্বগত ভাবে ঢুকে সৃজনশীল হবার কথা ভাবেননি,ভাবলে বলতেন না- ‘Every act of rebellion expresses a nostalgia for innocence and an appeal to the essence of beingএকে একাধারে কামুর নিজস্বতা, সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে শিল্পীর সচেতনতা, ও জীবনদর্শন রূপে চিহ্নিত করা যায়। কামুর উপন্যাস ত্রয়ে এই জীবনদৃষ্টি প্রতিফলিতসত্যের প্রথম স্বরূপ কামুর কথায়-‘What is a rebel? A man who says no……সেই সত্যের প্রকৃত শিল্পী- কামুর কথায়, ‘Truth, like light, blinds. Falsehood, on the contrary, is a beautiful twilight that enhances every object.’

‘ You cannot create experience.You must undergo it…………………………’

          কামুর সামাজিক জীবনে এমন একটা গতিশীলতা ছিল যা তাকে ১৯৫০ সালে ‘ Full time advocate for human rights’ হিসাবে পরিচিত করেছিল। তবে এর যাত্রা শুরু অনেক আগে। ১৯৩৫-এ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দ্য ওয়ার্কার্স থিয়েটার। অ্যালজেরিয়ার শ্রমজীবী শ্রেণীকে দিয়ে তাদের নিয়ে সমাজ সচেতন নাটক প্রযোজনাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। ১৯৩৯ পর্যন্ত এই দল সক্রিয় ছিল। ১৯৩৬-এ অ্যালজেরিয় কম্যুনিস্ট পার্টি এক সঙ্কীর্ণ সরকারি স্বাধীনতা ও শুধুমাত্র সেখানকার মুসলমান জনসংখ্যার স্বার্থসিদ্ধি করছে, এই প্রতিবাদে আরও জনহিতকর দলে সক্রিয় হলে, তাকে কম্যুনিস্ট পার্টি ট্রায়ালে ‘ট্রটস্‌কিস্ট’ তকমা দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। এছাড়াও ১৯৩৫-এ স্তালিন-লাভাল চুক্তিকে তাঁর ভণ্ডামো বলে মনে হয়েছিল। এ সময় থেকেই তাঁর মধ্যে কম্যুনিজম্‌ ও সোশালিজম্‌ এই দুই ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯-এর মধ্যে কামু যথাক্রমে ‘ অ্যালজের রিপাবলিক’ ও ‘সয়া-রিপাবলিক’-এর সাংবাদিক ও সম্পাদক ছিলেন এবং কাবিল এর আরবদের দুর্দশা ও তাদের নিয়ে রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।

          দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন কামুর গতিবিধি নিয়ে জীবনীকারদের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় আছে। ১৯৪০ সালে প্যারিসে আসা, বামপন্থী কাগজে সাংবাদিক হওয়া, ফ্রান্স আক্রান্ত হলে উত্তর আফ্রিকা চলে যাওয়া, ওরানে শিক্ষকতা করা, গণিতের শিক্ষিকা ফ্রান্সিনে ফরে-কে বিয়ে করা এবং জাতীয় নিরাপত্তার কারণে অ্যালজেরিয়া ছেড়ে যাবার আদেশ মেনে নির্বাসনে প্যারিসে আসার পর এই অদ্ভুত অনুভূতি হওয়া : ‘Paris is dead. The danger is everywhere. You go home and wait for the alert signal or whatever. I get stopped constantly in the street and asked for my ID. Charming atmosphere…’যদিও অল্পদিনের মধ্যেই তিনি অধিকৃত ফ্রান্সের মুক্তির জন্য সৃষ্ট গুপ্ত সমিতির সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। তবে এই সময় তিনটি পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে, নিজেই তাদের ‘ দ্য অ্যাবসার্ডস’ নাম দিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে, লেখা শেষ করার কাজে মন দেন। যেখানেই যেতেন তাঁর হাল্কা বাদামি গায়ের রঙ অন্যদের চোখে ধরিয়ে দিত যে তিনি প্যারিসের কেউ নন- এই অনুভূতি তাৎক্ষণিক ভাবে তাঁর মধ্যে এক নিঃসঙ্গ একাকিত্ব এনে দিয়েছিল। খসড়া তিনটিকে পূর্ণতা দেন, একি সঙ্গে- ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’, ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’ এবং ‘ দ্য প্লেগ’ নামে। পাশাপাশি নোটবইয়ের পাতা ভরে যেতে থাকে দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাবনা টীকা টিপ্পনীতে। কিন্তু প্রতিরোধ সংগঠন কমব্যাট-এ যোগদান, ‘বয় চার্ড’ ছদ্মনামে অধিকৃত ফ্রান্সে জাল পরিচয় পত্র নিয়ে ঘোরা ফেরা, তথ্য সরবরাহ ও ষড়যন্ত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ১৯৪৩ এর অক্টোবরে কমব্যাট পত্রিকার সম্পাদক হওয়া, গোপনে মানুষের কাছে পত্রিকা পাচার করে যুদ্ধের আসল খবর জানানো-তাঁর ব্যক্তিত্বের সপ্রতিভ দিকটি এত বড় করে তোলে যে জেনেরাল দ্য গ্যল্‌ তাকে ‘ বামপন্থী সন্ত্রাসবাদী বলে নজর না দিয়ে পারেননি। যক্ষ্মার আক্রমণে কাহিল শরীর নিয়েও অস্তিত্বকে তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে না দেখে, জীবনের প্রতিপদে যাচাই করে এগিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘In order to exist just once in the world, it is necessary never again to exist...এখানেই কামুর সঙ্গে সার্ত্রের সবচেয়ে বড়ো পার্থক্য। ভবিষ্যতে সম্পর্কের প্রকৃতি যাই থাকুক না কেনো, জঁ পল সার্ত্র জানান, কামুর এই জীবনই তিনি চেয়েছিলেন। পাশাপাশি যুদ্ধের পরপর আমেরিকায় গিয়ে সার্ত্রে-র অস্তিত্ববাদ ও ফরাসি অস্তিত্ববাদের অপব্যাখ্যা ‘ Philosophy of hopelessness ‘ শুধরে দেবার দায়িত্বও নেন। ১৯৪৪ সাল থেকেই কামু সমাজ পরিবর্তনের মুখপাত্র রূপে এক চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব। মার্কসিজম পরিত্যাগ করে নতুন সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে যে বি্রোধিতার বীজ বপন হয়েছিল ১৯৫১ সালে ‘দ্য রেবেল’ প্রকাশিত হবার পর ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়। ‘বিদ্রোহ’ শব্দটির দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক অভিধা কামুর সঙ্গে সার্ত্রর বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ করে। সত্যকে ভিন্ন ভিন্ন পরিভাষায় বিধৃত করা যায় না, কিন্তু মানুষ তা করে। তাই কামুর অকপট উপলব্ধি, ‘Man is the only creature that refuses to be what he is’‘দ্য রেবেল’ কামুর চেতনার যে ক্ষেত্রটি উন্মুক্ত করে তাঁর উপন্যাসে বা নাটকে প্রত্যক্ষভাবে কখনোই তা আসে না। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়ের চিন্তন, মনন, সৃষ্টি, বিপ্লব, রাষ্ট্র, যৌক্তিক ও অযৌক্তিক সন্ত্রাস, সত্য, আত্মপ্রবঞ্চনা এবং অবক্ষয়ের যুগের আসন্ন লক্ষণ কামুর Capstome Comment-এ ধরা পড়েছে। যা দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন তাকে নির্মোহ ভাষায় বলেছেন, “The society based on production, is only productive, not creative……

The Absurd is the essential concept and the first truth……………….

                             

উপন্যাস বা  কথাসাহিত্যে বিষয়বস্তু, কথন ও শৈলীর যে সফল পরীক্ষা কামু করেছেন, তা স্বীকৃত। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত ‘লে ত্রানজা’ শিরোনামের আমেরিকান অনুবাদ ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ আর ব্রিটিশ অনুবাদ ‘দ্য আউটসাইডার’, আধুনিক উপন্যাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দিলেও সেই পথে খুব একটা কাউকে যেতে চোখে পড়ে না। এই বহু আলোচিত উপন্যাসটি কেন্দ্রীয় চরিত্র মরসঁ-এর মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে শুরু এবং নিজের ফাঁসির আদেশে চেতনার সাধারণ গলিপথে হারিয়ে শেষ। প্রথার প্রতি, সামাজিক রীতি নীতি ও বিধির প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন অ্যালজেরিয়ার এক সরল কেরানি যুবক এই গ্রন্থের নায়ক-যে জগতের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। কোনো কিছুকে না মানার কোনো কারণ সে নিজে থেকে অন্বেষণও করেনি। মা’র মৃত্যুতে সে অভিভূত নয়, মা-র শেষকৃত্য তার কাছে ক্লান্তিকর, এবং শোকস্তব্ধ পরিবেশকে তার মনে হয়েছে অন্তঃসারশূন্য-এই ক্লান্তিকর প্রথার শেষে সাঁতার কেটে সে তাঁর ক্লান্তি দূর করে। বান্ধবীকে সে ভালোবাসে কিনা সে বিষয়ে সে নিশ্চিত নয়।প্রায় অনিচ্ছাকৃত ভাবেই সে একটা খুন করে। মামলার সময়ে নিজের ভবিষ্যত তার কোনো উৎকণ্ঠা নেই। আদালতে সমবেত ঘৃণিত দৃষ্টি তাকে স্পর্শ করে না। ফাঁসির আদেশের রায় শুনে তার কোনো বিকার দেখা যায় না। কিন্তু, কাহিনীর শেষ মুহূর্তে পাদ্রী যখন ঈশ্বরের নাম শোনাতে আসেন তখনই আমরা তার ক্ষুব্ধ জীবনবোধ শুনতে পাই। তার জিজ্ঞাসা-‘জগতের সবচেয়ে অনিশ্চিত সত্ত্বা সম্পর্কে তোমরা এত নিশ্চিত কেন?’

এই অদ্ভুত মানুষটির জীবনবোধকে চিহ্নিত করে যে শব্দ প্রায় গোত্র নির্দেশকারী /ধারা নির্দেশক (Shibboleth) হয়ে উঠেছে তা শিল্পী ও সমালোচকদের অতিপ্রিয়-‘অ্যাবসার্ড’। এর থেকেই আধুনিক সাহিত্যে ‘absurd’ ধারণাটির উদ্ভব। কারণ মরসঁ যে জগতে বাস করেছে সেই জগতটাও অ্যাবসার্ড।এই শব্দের প্রতিশব্দ ‘ridiculous’ নয়। কোনো নেতিবাচক ধারণা নয়, একে পরিভাষায় ‘a true state of existence’  বা  ‘the absence of universal logic’ এই জীবনবোধ নিৎসের ‘God is dead’-এর চেয়েও র‍্যাডিকাল।

তবে, ‘অ্যাবসার্ড’ ধারণাটির বিরুদ্ধেও কামুর প্রতিবাদ দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রথম দিকে হয়ত প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ অনেকটা stoic acceptance-এ স্থিত হবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।পরে, যেমন ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে, এই প্রতিবাদ একটি ভিন্ন মাত্রা লাভ করে-শুধু বিউবনিক প্লেগের বিরুদ্ধে ওরান-এর মানুষের বাঁচার সংগ্রাম নয়, নীৎসে ও সপেনহাওয়ার-এর ‘will to endure’ বা বাঁচার তীব্র উদ্দাম ও অকপট ইচ্ছা-শক্তির সঙ্গে মানুষ হিসেবে নিজেকে মৃত্যুর সামনে সম্ভ্রমের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস স্পষ্ট। তাই ১৯৫৪ সালে ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য রেবেল’ প্রবন্ধ বিতর্কের সূত্রপাত করে। তাঁর মতে, ‘শেষ কথা’ বলার দাবিদার এমন দর্শনচর্চার ক্ষেত্রগুলি-যেমন, খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যেই মানুষের উত্তরণের পথ নিশ্চিত, বা, মার্ক্সিয় দর্শনই মানুষ ও সমাজের ঐতিহাসিক উত্তরণের ‘শেষ কথা’-এই absolutist  ধারণাগুলি প্রবঞ্চনমূলক মতবাদ। সময় বিশেষে তাঁকে এও বলতে দেখা গেছে, যে মানবিকতা, বিশেষত মেডিটেরানীয় মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, ‘deceptive doctrines’ মানার চেয়ে অনেক গ্রহণযোগ্য। পরিবেশ, মানুষের বহিঃপ্রকৃতি ও মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি-এই তিন তারের সুর মেলানোর মধ্যে কামুর psycho-social aesthetics-এরও চেতনা ধরা পরে। ইতিহাস-নিয়তির মধ্যে হিংসার যে বারুদ রয়েছে, তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার স্পর্ধা রাখতেন। জাঁ পল সার্ত্রর সঙ্গে পরবর্তীকালের তিক্ত বিতর্কের সূত্রপাত এখান থেকেই। ১৯৫১ সালে ল্য নুভে লেতারে-তে প্রকাশিত গেব্রিয়েল দ’বারেদে-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কামু ‘অ্যাবসার্ড’ শব্দটি নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করেন : “অ্যাবসার্ড শব্দটির সঙ্গে আমার এক দুঃখজনক অনুষঙ্গের ইতিহাস রয়ে যাচ্ছে। বলতে বাধা নেই, আজ এই প্রসঙ্গ উঠলেই বিরক্তি আসে। ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’-এ যখন আমি অ্যাবসার্ড অনুভূতির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করছি, তখন কিন্তু আমি কোনো মতবাদ নিয়ে বা মতবাদের খোঁজে আলোচনা করছি না, করছি একটি পদ্ধতির সীমা-পরিসীমার অনুশীলন। প্রথমে আমার চেষ্টা ছিল একটা ‘tabula rasa’ তৈরি করা, তার পরে সম্ভাব্য কিছু তৈরি করা। যদি আমরা ধরেই নি যে জগতে কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই, তাহলে সিদ্ধান্তে আসতেই হয় যে জগতটা অ্যাবসার্ড কিন্তু কোনো কিছুরই কি কোনো অর্থ নেই? আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি যে এই সিদ্ধান্তে আমরা নিশ্চিন্তে থেকে যেতে পারব।

                           

এর পর তাঁর ‘দ্য ফল’ (লা স্যুতে, ১৯৫৬) উপন্যাসের একটি দিক উল্লেখ করে ‘দ্য প্লেগ’ (লা পেস্তে, ১৯৪৭) নিয়ে আলোচনা করব। শেষ উপন্যাস ‘দ্য ফল’-এর মধ্য দিয়ে এক আইনজীবীর জাঁ বাপ্তিতে ক্লেমেন্‌স, সুবিচার পাবার সংগ্রাম এবং তার আত্ম-অপরাধের গ্লানি প্রকাশ পেয়েছে। আত্মহত্যায় উদ্যত এক নারীকে উদ্ধার করার মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে যে আত্ম- জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে, তাই নায়ককে এনে নামিয়ে দিল এক পশ্চাদমুখী মানসিকতা। এই দুই উপন্যাসে আত্মকথন পদ্ধতি কামুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আত্মকথনের মধ্য দিয়ে তার অন্তর চেতনা যেন শেষ পর্যন্ত বহির্চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভাষাগত সারল্য, সূক্ষ্ম বৈদগ্ধ, অন্তঃসলীলা এক বেদনাবোধ কামুর স্টাইলের অন্যতম দৃঢ়তা ।     

                               

‘দ্য প্লেগ’ একটি আখ্যায়িকামূলক উপন্যাস, পরিভাষায় Chronicle  হলেও এই উপন্যাস ‘writer of writer’s’-এর উপাদানে সমৃদ্ধ। প্লেগাক্রান্ত এক বদ্ধ ও নিষিদ্ধ শহরের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এতে নিখুঁতভাবে বিবৃত হয়েছে। ওরান নগরীতে মৃত্যু যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে অথচ সেই নগরী থেকে বেরোনও নিষিদ্ধ। জীবন ও মৃত্যুর অনিশ্চয়তার শৃঙ্খলে শুধু নাগরিকরা নন পাঠকও শৃঙ্খলিত হয়। অনুপুঙ্খ দলিলে কামু ধরে ফেলেছেন মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে জীবন ও মৃত্যুকে যৌথভাবে দেখলে, জীবন-মৃত্যু সম্বন্ধে যে প্রথাগত ধারণা মানুষের সম্বল, তার দ্রুত স্থান পরিবর্তন। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ড. রিউ, শেষ পর্যন্ত নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদী হলেও জীবনবিশ্বাসী। অনিবার্য পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চূড়ান্তভাবে মৃত্যুর হাতে পরাজয়ের সামনে থেকেও, ড.রিউ মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে জীবনের ব্রত খুঁজে পেয়েছেন। এই গ্রন্থের অন্তরালে জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি একটি সর্বজনীন সত্যও রয়েছে : কিভাবে রাজতন্ত্র, সংখ্যাগরিষ্ঠ একনায়কতন্ত্র, সামরিক একনায়কত্ব বা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রতন্ত্র মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে বন্দী করে রাখে। কামুর এই উপন্যাসে অস্তিত্ববাদের ছয়টি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে দেখা গেলেও, তিনি মূলত এখানে মানবতাবাদী বা মানবতন্ত্রীঅস্তিত্ববাদী সূত্রগুলো যেন ফুলে ওঠা শিরার মতো প্রত্যক্ষ : প্রথম, “আমি আমার সচেতন অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু নই” ; দ্বিতীয়, “অনির্দিষ্ট উৎকণ্ঠা”, তৃতীয় “অ্যাবসারডিটি”, যেখানে “কেন এখন, কেন এখানে’ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই; চতুর্থ, “শূন্যতাবোধ”-ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রথা, সমাজ যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তার প্রতিবাদে বা তাকে বাদ দিলে এক ভয়ঙ্কর শূন্যতাবোধ আগ্রাসনে চলে যাওয়া চেতনা ; পঞ্চম, “মৃত্যু”, যাকে জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডগার(১৮৮৯-১৯৭৬) বলেছেন “ My most authentic significant moment, my personal potentiality, which I alone must suffer” , যাকে সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ পরিচিত করাচ্ছে “What is Death? Death is my total non-existence”, সচেতন অস্তিত্বকে চিরন্তন অনস্তিত্বে মুছে ফেলা; ষষ্ঠ, “বিচ্ছিন্নতাবোধ”, দার্শনিক হেগেলের বিংশ শতাব্দীর সৃজনশীল চেতনাকে সবচেয়ে বড়ো দান। অস্তিত্বের অর্থহীনতা, চেতন অস্তিত্বরূপে মানুষের অস্তিত্বের চূড়ান্ত তাৎপর্যহীনতা, তার থেকে উদ্ভূত শূন্যতা, অব্যাখ্যেয় উৎকণ্ঠা ও বিষাদকে বিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদীদের আগেই অবশ্য এদের পূর্বসূরী সোরেন কিরকেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫) চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন ; “আমি আমার আঙুল রাখলাম অস্তিত্বের ওপরে-কই কিছুই তো হল না। আমি কোথায়? আমি কোথায়? এই যে জগত বলে জিনিসটা, এটা কি? কে যে লোভ দেখিয়ে, হাতছানি দিয়ে এর মধ্যে আনল, আর আমায় ছেড়ে চলে গেল এখানে? আমি কে? কিভাবেই বা জগতে এলাম? আমায় কেন জিজ্ঞাসা করা হল না?” অস্তিত্ববাদের মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের এই অর্থহীনতা আসলে একটি বিশ্বাসের মৃত্যুর শীতল সমাধি। ১৮৮২ সালে ‘দ্য জয়ফুল উইসডম’ গ্রন্থে নীৎসে(১৮৪৪-১৯০০) যখন দেখিয়েছিলেন উজ্জ্বল সকালে কালো কাঁচের জ্বলন্ত লন্ঠন হাতে এক পাগল বাজারে ভগবানকে খুঁজে খুঁজে, উত্তেজিত জনতাকে চিৎকার করে জানালো ‘ঈশ্বর মৃত’, তখন সে আরো বলেছিল-“আমরা তাঁকে মেরেছি, আমরা...তুমি,আমি! আমরা সবাই খুনি......আমরা কোন দিকে চলেছি? এবার কি আমরা সীমাহীন শূন্যতায় ভুগব? এই শূন্যতা ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে না? নিঃশ্বাস টা ঠাণ্ডা...তাই না? কি, শুধুই রাত আর রাত। অন্ধকার আরো অন্ধকার, তাই না?” কামু উপন্যাসের ঈশ্বর বিশ্বাসহীন জগতের সত্য ও নৈতিকতার মৃত্যু দেখা যায় না। বিশ্বাসের ওপর একের পর এক আঘাত ঈশ্বরের মৃত্যু ঘটিয়েছে, কিন্তু ওই ‘মালটিপল ইনজুরি’ তে কামু নিরীশ্বর জগতে সত্য ও নৈতিকতার-মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের অস্ত্র ও ঢাল দুইই-ভিত্তি ভেঙ্গে যায়নি। ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে কামুর চরিত্রের-ড. বার্নার্ড রিউ, ফাদার পেত্রিলো, জাঁতারো, রেমন্ড র‍্যামবার্ট, আর জোসেফ গ্র্যান্ড মৃত্যুর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত। অস্ত্র একটাই : জীবন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের একটি অস্ত্র, জীবন।

একটি তথ্যচিত্র নির্মাণে কামু আবিষ্কার করে চলেছেন, টি.এস.এলিয়ট এর ভাষায় “...The skull beneath the skin”কামুর উপন্যাসের নামটি ‘দ্য প্রিজনারস্‌’ থেকে বদলিয়ে ‘দ্য প্লেগ’ করেন মৃত্যু ও জীবন উভয়ের অনিশ্চয়তার একটি চূড়ান্ত পরিস্থিতির দিকে আলোক সম্পাত করবেন বলে। মৃত্যুর মুহূর্তে কতটা সংগ্রাম প্রতিটি চরিত্র করতে পারছেন, কতটা লড়াই তারা করছে তার সচেতন প্রয়াস উপন্যাসটিকে যেন গ্রীক দার্শনিক সোক্রাতিসের জীবনবোধের সমান্তরাল করে তুলেছে, “….the unexamined life is not worth living “ড.রিউ তার জীবনের শেষ মুহূর্তে, পরাজয়ের নিস্তব্ধতার মাঝে শেষ নিষ্ঠুর পরাজয়ের পর অমোঘ এক শান্তি চুক্তিতে নিশ্চিহ্ন হবার ব্যাপারে সচেতন। উপন্যাসের সবচেয়ে মূল্যবান উপলব্ধি জীবনকেন্দ্রিক-সেখানে জীবনের অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুর নিশ্চয়তা কোনোখানেই কাহিনীর সাব্লিমেশন নেই।

“How can sincerity be a condition of friendship? A taste of any cost is a passion which spares nothing…….”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সার্ত্র আর কামুকে কাছাকাছি নিয়ে আসে(জুন ১৯৪৩), আর রাজনৈতিক বিশ্বাস তাদেরকে পৃথক করে। তাঁদের বন্ধু সিমোয়ে দ্য বভয়াঁ দুজনের বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এছাড়া সোভিয়েত কম্যুনিজমের উত্থান তাদের দুজনের বন্ধুত্বের পতনকে দ্রুততর করে। একমাত্র কামুর মৃত্যুর পরেই আবার সার্ত্রকে পুরনো বন্ধুর প্রতি উদার প্রশংসা করতে দেখা যায়। অথচ চল্লিশের (১৯৪০)  দশকের মাঝামাঝি ‘দ্য লেফট্‌ ব্যাঙ্ক’ নামে পরিচিত সেন্ট জাঁমে বুলেভার্ডে এই তিন ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের নিয়মিত বসতে দেখা যেত কাফে দ্য ফ্লরে-তেতখন সেখানে মতৈক্য ছিল এমন বিষয় নিয়েই আলোচনা চলত- যেমন, এই জগত নির্দয় ভাবে যুক্তি-কারণবিহীন, কোনো আধ্যাত্মিক শক্তির অস্তিত্ব নেই, মুক্তি বা স্বাধীনতার মধ্যে এক মৌলিক হতাশা নিহিত রয়েছে। এর আগে অবশ্য সার্ত্র ও কামু মানবিকতাকেই জীবনের কেন্দ্রীয় মূল্যবোধরূপে স্বীকার করেছিলেন। পরে কামু যখন সোভিয়েত পদ্ধতিকে অস্বীকার করলেন, তখন সার্ত্র, কামু ওই কেন্দ্রীয় মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করেছেন বলেই প্রচার করেছিলেন।

সার্ত্রর নাটক ‘দ্য ফ্লাইস’-এর উদ্বোধনে ১৯৪৩-এর জুন মাসে এসে কামু নিজেই গিয়ে আলাপ করেন সার্ত্রর সঙ্গে। ১৯৩৮-এ সার্ত্রের ‘নসিয়া’ উপন্যাস ও ১৯৩১-এ সার্ত্রের গল্পসংগ্রহ ‘দ্য ওয়াল’-এর রিভিউ করেন কামু।কথন ও অ্যাবসার্ড জীবন দৃষ্টির প্রয়োগের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন কামু। কাফকা-র সঙ্গে সার্ত্র-র পার্থক্য, বিশেষত সার্ত্রর ‘handling of negativism’   নিয়েও কামুর মন্তব্য চোখে পড়ার মত ছিল। সেই সমালোচনা বা রিভিউ সার্ত্র পড়েওছিলেন। অন্যদিকে ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ উপন্যাস-খ্যাত কামু দার্শনিক প্রবন্ধগুচ্ছ ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’-এরও লেখক- যাকে বছর খানেকের বেশি সার্ত্র চেনেন। আলাপের শুরু “ I’m camus ” সার্ত্র পরমুহূর্তেই তাঁর বন্ধু সিমোয়ে দ্য বভঁয়াকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন-‘I have found in him a most likable personality’ এর পাঁচ মাস পরে নভেম্বর মাসে কাফে ফ্লরে-তে কামুর নাটক নিয়ে উৎসাহ ও অভিজ্ঞতাকে দেখে, সার্ত্র তাঁর নতুন নাটক ‘নো এক্সিট’ মঞ্চস্থ করার ও মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার প্রস্তাব তাঁকে দেন সার্ত্রর আগ্রহ ও অনুরোধের সামনে কামুর দ্বিধা প্রশ্রয় পায়নি। নাটকটি মঞ্চসফল হবার পরে যখন প্যারিসের পেশাদারী মঞ্চে উপস্থাপিত হওয়া স্থির হল, তখন কামু ভদ্রভাবে সেই আয়োজন থেকে সরে যান। যদিও এতে বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি, বরং সার্ত্র সম্পর্কের প্রকৃতিকে স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছিলেন : “His youth and independence created bonds between us : we were all solitaries, who had developed without the aid of any ‘school’ ; we belonged to no group or clique”২০ বছর ধরে কামু ও সার্ত্রর সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন কামুকে চিনতে অনেক বেশি সাহায্য করে। তাঁর র‍্যাডিকাল চলিষ্ণু মননে এক দার্শনিক সবসময় ধরা পড়ে যার প্রশ্নের প্রকৃতি, তাঁর জীবন ও বিশ্বজিজ্ঞাসার স্বরূপ নিয়ে অনিশ্চয়তাকে মুখোমুখি দেখাতে বাধ্য করে। মূলত সাহিত্যিক ও দার্শনিক বিশ্বাসের পরিকাঠামোগত সাযুজ্য তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ককে ধরে রেখেছিল। কিন্তু প্রশ্ন ও উত্তর, তর্ক ও বিতর্ক, অভিযোগ ও প্রত্যাভিযোগ, মতবাদ ভিত্তিক প্রস্তাবনা ও খণ্ডন কামু ও সার্ত্রর মধ্যে যে intellectual repertoire সৃষ্টি করেছিল, তা বিদগ্ধ মনকে সমৃদ্ধ করতে বাধ্য। তাঁর নিজের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে কামুর লেখাকে উদ্ধৃত করেছেন এবং কাফকা ও হেমিংওয়ে-র সঙ্গে কামুর তুলনার ঐতিহ্যেরও সূচনা করেন। কামু তাঁর নিজের সৃজনশীল প্রবৃত্তির সঙ্গে সার্ত্রর মননসিদ্ধ সমালোচকের বৌদ্ধিক প্রকৃতির দূরত্ব দেখতে পান,তা চিহ্নিত করেন এবং সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রটির মানদণ্ড নিয়েও প্রথাগত ও অপ্রথাগত প্রবন্ধ চর্চার কাঁটাতারের এপার-ওপার দেখাবার সাহসী প্রয়াস নেন, আসলে, কামুর চিন্তার ভিত্তি যেসব প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, তা জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য অন্বেষণের তাড়না, আর তিনি থেকেও গেছেন অভিজ্ঞতার জগতে, যে জগতে হতাশা ছিল সঙ্গী- চেষ্টা করেননি পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনো ধ্রুপদীর দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব মীমাংসায় নিশ্চিত হতে। তাই কামুর সমালোচনায় এমনকি সার্ত্রর সাহিত্য ও দার্শনিক প্রবন্ধের সমালোচনায়ও, acid tone থাকত না। কামুর নিজের ভাষায় এই ‘acid tone’, যা সার্ত্রর রিভিউ তে থাকতই তা কোনো তীব্র আক্রমণ নয়, যেন অনেকটা বুদ্ধির এক ঝাঁঝালো গন্ধ, যা সৃষ্টির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তিকে ধরবার ব্যর্থ প্রয়াস। এর ফলে পাশাপাশি দেখলে, সার্ত্রকে মনে হবে তাত্ত্বিক ঔপন্যাসিক, যার বিশ্ব জিজ্ঞাসা এক বিশ্বাসে স্থিত হয়েছে- জগতের কেন্দ্রে রয়েছে এক অনতিক্রমণীয় অ্যাবসার্ড অভিজ্ঞতা; দুর্লঙ্ঘ্য । সার্ত্রর ‘নসিয়া’ ও ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’-এ একটি ভাবনার অনুক্রম লক্ষ্য করা যায়। এক অর্থহীন অস্তিত্ব ও জগতকে মানুষের কাজ ও অভিযান সংগঠিত করে চলেছে।

দুজনের পার্থক্য সত্ত্বেও বিষয় নির্বাচন, ফরাসি শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে পৃথক কিছু করার প্রয়াস, দর্শন ও ধর্মসাহিত্যে অবাধ বিচরণের নমনীয়তা, অপ্রচলিত প্লট, বৈশিষ্ট্যহীন চরিত্রের উপর আকর্ষণ, অ্যাবসার্ড অস্তিত্বের বেড়া ডিঙিয়ে না যাওয়ার প্রবণতায় তারা নিজেরাও জানতেন সৃজন-মনন-দর্শনের কতটা তারা ভাগ করে নিয়েছেন। দুজনেই দর্শন ও সাহিত্যে মৌলিক অবদানের ক্ষমতা নিয়ে এসেছিলেন, সফল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, শৈলীর পরীক্ষায় যতটা যাওয়া যায় গেছেন- কিন্তু সার্ত্র স্বভাবতই দার্শনিক, ভাবনা-চিন্তা, তত্ত্বের বিশ্লেষণে শৃঙ্খলাপরায়ণ। কামু মূলত ঔপন্যাসিক, মূর্ত প্রেক্ষাপট সহজে অভিজ্ঞতা-বন্দী করা তার অনায়াস স্বভাবের প্রকাশ। প্রায় বধির বিধবা মার কাছে দারিদ্রের পাঠ কামুকে সমাজতন্ত্র ও অস্তিত্ববাদী তত্ত্বের আদর্শ শিকার রূপে বেছে নিতে পেরেছিল কিনা তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, কামু একপেশে তত্ত্ববাদী হয়ে জীবন কাটাননি। কামুর অভিজ্ঞতা ছিল- ব্যর্থতা, হতাশা, দারিদ্রের- অভিজ্ঞতা একপেশে তাত্ত্বিক তৈরি করেই, কিন্তু তা হয়নি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সার্ত্র বা সমকালীন ফরাসি বুদ্ধি ও চিন্তাজীবীদের চেয়ে পৃথক, এছাড়াও নিজস্বতায় স্নিগ্ধ ছিল। তাই তাঁর ভাষায় তত্ত্ব ও তত্ত্ব-চিন্তকের স্থান জীবন ও জগত-জিজ্ঞাসু ও অস্তিত্বসংঘাতে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরে, কারণ-“An intellectual is someone whose mind watches itself ……those who lack courage will always find a philosophy who justify it.” অস্তিত্বের অ্যাবসার্ড ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়ে, পায়ের নিচে সরে যাওয়া বালির ওপর দাঁড়িয়ে,কামু প্রতিবাদ করেছেন, উত্তরণের চেষ্টা করেননি। এখানেই তাঁর শৈল্পিক উৎকর্ষ। এখানে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি : “How hard, how bitter it is to become a man..”

“Without culture and the relative freedom it implies, society, even when perfect is but a jungle….”

                        

সাহিত্যিক, দার্শনিক ও কামুর সমসাময়িক জাঁ পল সার্ত্র অস্তিত্ববাদী হলেও শেষপর্যন্ত একটি বিশেষ মতাদর্শকে মেনে নিয়েছেন।তাঁর ‘Critic of Dialectical Reason “-এ কম্যুনিজম্‌ ও অস্তিত্ববাদের একটি সমন্বয়ের চেষ্টা তিনি করেন। কিন্তু কামু ব্যক্তির স্বাধীনতার জন্য কোনো চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেননি। তাঁর আপোষহীন স্বাধীনতাস্পৃহা তাঁকে রুদ্ধ করতে পারেনি। ১৯৩৮ সালে লিখিত ‘ক্যালিগিউলা’ নাটকে একদিকে আত্মপীড়নবাদ শেষ পর্যন্ত যে আত্মবিধ্বংসীবাদে পরিণত হয় তা যেমন উদ্ভাসিত হয়েছে, তেমনি রয়েছে, যে প্রবল অশুভ শক্তির হাত থেকে মানুষকে বাঁচাবার মত কোনো শুভ বা দৈবশক্তি, বা নৈতিক আধ্যাত্মিক শক্তি জগতে নেই। সৃষ্টির এই নিষ্ঠুর দিকটি কামুর অ্যাবসার্ড ধারণার জন্মদাতা। এই প্রসঙ্গে সত্যের আরেকটি ভাষ্য তাঁর ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’ প্রবন্ধ। এই বস্তুতান্ত্রিক জগতে মানুষ শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যুগে যুগে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তবুও সে চেষ্টা করে চলেছে। কামুর সৃষ্টিশীল রচনায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র, অ্যালজেরিয়া-আকাশ,সমুদ্র,আলো,মরুভুমি বার বার এই সীমিত জীবনে যেন মুক্তির প্রতীক হয়ে এবং অবাধ স্বাধীনতার রূপক হয়ে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর তাত্ত্বিক উপন্যাসে যে জীবনবোধ যুক্তি-মননের তীক্ষ্ণতায় তাত্ত্বিক খোলসে আশ্রয় নিতে দেখা যায়, কামু যুক্তি তর্ক ছাড়াই জীবনের গভীরতম সত্যকে সূক্ষ্ম মনোবিশ্লেষণের সাহায্যে, চরিত্রের মধ্যে দিয়ে, এক মোহমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন।১৯৫৭ সালের ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমের নোবেল পুরস্কার বক্তৃতায় কামু বলেন :

 “প্রত্যেক প্রজন্মের সমাজ সংস্কার করার একটা দায়বদ্ধতা থাকে। তবে আমাদের প্রজন্ম বোধহয় সেই সংশয়ের পথে গেল না। তাই দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। জগৎকে জগতের হাত থেকে, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। এক দুর্নীতিগ্রস্ত ইতিহাসের উত্তরাধিকার  পেয়েছি, সেখানে অসফল বিপ্লব, উদ্দাম প্রযুক্তি, মৃত দেব-দেবী, ভগবানের শব, বস্তাপচা তত্ত্ব, যেখানে মধ্যমবর্গ ক্ষমতা গ্রাস করে ধ্বংসকে নিশ্চিত করছে, যেখানে বুদ্ধি অবনমিত হয়ে ঘৃণা ও শোষণের ভৃত্যে পরিণত হয়, সেখানে এই প্রজন্মকে জীবন ও মৃত্যুর ন্যূনতম সম্ভ্রম পুনরুদ্ধার বা প্রতিষ্ঠা দিতে হবে......যারা এই সত্যকে মানতে পারবে তাদের আমি এই সম্মান আমার হাত থেকে তাদের হাতে তুলে দেব...”১৯৬০ সালের ৪ জানুয়ারি এই চিরঅশান্ত, চিরস্বাধীন মানুষটি এক অটো দুর্ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে চিরন্তন অনস্তিত্বে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের মানসিক সম্পদ হিসেবে তাঁর অস্তিত্ব চিরকালের জন্য অজেয় হয়ে রইল। একটি ভাবনার অনুরনণ বহুবার বহু জায়গায় কামুর কাছ থেকে শোনা গেছে, কথাগুলো দার্শনিক কিরকেগার্ডের (১৪১৩-১৮৫৫)

 জন্ম দেবার সময় মা-র আর্তচিৎকার শুনেছ, মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষের শেষ সংগ্রাম, কষ্ট দেখো-- যা এইভাবে শুরু ও শেষ হয়, তা কখনোই কোনো আনন্দময় পরিকল্পনা হতে পারে না।