বিষয় আত্মহনন
আলোচকঃ মহুয়া সাহা

ভাষাবন্ধন-সমাজ-সাহিত্য-শিল্প সংস্কৃতি সিরিজের সংকলন প্রতি বারই চমকপ্রদ কোন না কোন বিষয় নিয়ে হাজির হয় পাঠকদরবারে। তার মধ্যে “বিষয় আত্মহনন” (প্রকাশকাল ২০১০) সংখ্যাটি পাঠক হিসেবে আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষক ও সমৃদ্ধ বলে মনে হয়েছে।
‘আত্মহনন’ শব্দটি যেহেতু এমনিতেই অত্যন্ত রহস্য ঘেরা আর সেই বিষয় কে নিয়ে কোন প্রবন্ধ সঙ্কলন করা যেতে পারে এই বিষয় ভাবনাটাই আমায় আশ্চর্য করেছে। তবে এখানে আত্মহননকারীগণ প্রত্যেকেই নিজস্ব শিল্প ক্ষেত্রে দিকপাল। কিন্তু তা সত্তেও এমন সৃষ্টিশীল মানুষরা কোন বা কোন বিশেষ বোধ দ্বারা চালিত হলেন এবং নিজেদের সঁপে দিলেন অনির্দেশ্যের পথে, এই প্রবন্ধ সঙ্কলন চেষ্টা করেছে আমাদের কাছে শেই মারাত্মক আত্মহননকারী বোধটিকে খুঁজে দিতে।
প্রবন্ধ সঙ্কলনটির রহস্যঘন প্রতীক সম্বলিত ও আলো ছায়াময় পরিচ্ছদটি প্রথমেই পাঠকবর্গ কে যেন চালিত করে বই খুলে দেখতে। আর বিষয়ের সাথে যে প্রচ্ছদ দারুন সঙ্গত করেছে একথা না স্বীকার করে পারা যায় না। ইংরাজি সাহিত্য,বাংলা সাহিত্য ও আঞ্চলিক সাহিত্যের পন্ডিত প্রবর রচিয়তা দের আলোচনার সম্মুখীন হই এই সঙ্কলনে।
তবে এই সঙ্কলনের দুটি প্রবন্ধ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সবচেয়ে বেশি। প্রাবন্ধিক হলেন ইংরাজি ও বাংলা উভয় ভাষা ও সাহিত্যের মননশীল লেখক অভীক গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথমেই যে বিষয়টি চোখে পরে তা হল-তিনি হলেন একমাত্র এই গ্রন্থের প্রাবন্ধিক যিনি ইংরাজি সাহিত্যের দিকপরিবর্তনকারী খ্যাতনামা দুজন মহিলা কবির আত্মহননের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
ভার্জিনিয়া উল্ফ ও সিল্ভিয়া প্লাথের মত ক্ষণজন্মা বলিষ্ঠ লেখিকা আজও সাহিত্যে বিরল। কিন্ত লেখনীর দ্বারা মনোহরণকারী লেখিকাগণের মন যে কিভাবে মৃত্যুর দ্বারা প্রলুব্ধ হল সেই বৃত্তান্তটি সম্পূর্ণ অজানা থেকে যেত আমার কাছে যদি না আমি সম্মুখীন হতাম।
অভীক গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটিকে আমি ব্যক্তিগত সমালোচনার (personal criticism) আঙ্গিকে যদি বিচার করতে যাই তাহলে প্রথমেই বলতে হবে প্রবন্ধটিতে আত্মহনন বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে রচয়িতা যেভাবে মৃত লেখিকাগণের পূর্বতন জীবনের টুকরো টুকরো ছবি সাজিয়ে নাতিদীর্ঘ আকারে উপস্থাপন করেছেন,তা গঠনগত দিক থেকে আদর্শ বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ(Formal or Informative Essay) হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।
প্রবন্ধ দুটি তে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণে অযথা অতিরিক্ত ঘটনার ঘনঘটার ভারে ভারবহ করে করে নয়।
‘নিরর্থক প্রহসনের ইতিঃ ভার্জিনিয়া উলফ’- শীর্ষক প্রবন্ধটিতে শিরোনামটাই সমগ্র বিষয়ের ইঙ্গিতবাহী। ভার্জিনিয়ার কাছে ছেলেবেলা থেকে দীর্ঘ ঊনষাট বছরের পথ চলা ছিল নিছক এক তামাশা। এই সত্যটাই প্রাবন্ধিক এই প্রবন্ধের পরতে পরতে যে খুলে দেখাতে চেয়েছেন তা পড়লেই বোঝা যায়।প্রাবন্ধিক এই প্রবন্ধটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করেছেন আর সেই অংশগুলির শীর্ষে একটি করে ইংরাজি কোটেশন দিচ্ছেন যা লেখিকার নিজেরই লেখা। আর সেই কোটেশন গুলির উপর ভিত্তি করে যখন প্রাবন্ধিক বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন তখন আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে মৃত লেখিকার জীবিত থাকাকালীন সময়ে মনের দোলাচলতার কথা।
আবার পরের প্রবন্ধ ‘সিল্ভিয়া প্লাথঃ নির্জন হাতে মৃত্যুকে অভ্যর্থনা’- তে কিন্তু অভীক বাবু পূর্বের প্রবন্ধের ন্যায় একই ধরণের স্টাইল রাখেননি। এখানে কোন অংশ বিভাজন নেই। ভার্জিনিয়া শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুই হয়েছে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে মৃত্যুর দৃশ্যের অবতারণা করে কিন্তু সিল্ভিয়া প্লাথ সংক্রান্ত প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক শুরুটা করেছেন যেন ছোটগল্পের আঙ্গিকে। আর সেই বলার ভঙ্গিমা এতটাই সহজ যে নির্দ্বিধায় তা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় ঘটনাগুলিকে মানসচক্ষে উপলব্ধি করানোর মধ্যে দিয়ে। ছোটোগল্প কথাটি আমি এই কারণে উল্লেখ করলাম কারণ ‘সিল্ভিয়া প্লাথ’ পড়তে পড়তে যত শেষের দিকে এগোতে থাকি ততো যেন উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। আর একেবারে শেষে থাকে এক ভীষণ অতৃপ্তি।যা আদর্শ একটি প্রবন্ধেরও লক্ষন। আরও একটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে উক্ত প্রবন্ধের তা হল এখানে প্রাবন্ধিক লেখিকার মানসিক পরিস্থিতি বোঝাতে তাঁর জীবনের অস্থির নানা মুহূর্তে লেখা তাঁর বিভিন্ন কবিতার টুকরোগুলি তুলে ধরেছেন। ফলে প্রাবন্ধিক নিজে কিছু লিখে না বোঝালেও মৃত লেখিকার মানসিক দ্বন্দ্বের রূপটি আমরা অনুধাবন করতে পারি।
প্রতিটি প্রবন্ধের শেষেই প্রাবন্ধিক প্রথাগতভাবে গ্রন্থঋণ স্বীকার করেছেন। যার ফলে আমাদের মত উৎসাহী পাঠকগণ বিষয়গুলি আরো গভীরভাবে জানতে অন্যান্য গ্রন্থের সাহায্য নিতে পারে।
প্রাবন্ধিক অভীক গঙ্গোপাধ্যায় প্রবন্ধ দ্বয়ে অত্যন্ত আত্মসচেতনভাবে নিজের লেখনীর সাথে পাঠকের হৃদয়ের সংযোগ ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন।নিছক জ্ঞানলাভ নয় আনন্দলাভ ও যে পাঠক হিসাবে পরম প্রাপ্তি তা স্বীকার না করে পারা যায় না।।