Book Review, Sarasvati, DHAKA REVIEW, Bangladesh 25/07/2017 BOOK REVIEW by DEEP CHATTERJEE deepchatterjee2007@gmail.com SARASVATI by Avik Gangopadhyay Published by GYAN DARPAN, Kolkata গ্রন্থ : সরস্বতী লেখক : অভীক গঙ্গোপাধ্যায় আলোচক : দীপ চ্যাটার্জি “সরস্বতী”―এই শব্দটি শুনলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে আসে বিদ্যার দেবীর কথা। মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে যাঁর পূজা করা হয়। আজকের বঙ্গসমাজের কাছে সরস্বতীর তাৎপর্য এইটুকুই। কিন্তু এইটুকুই কি সবটুকু? না, কখনোই নয়। কোনদিনই ছিল না। তাহলে সরস্বতী আসলে কে? কোথায় তাঁর উৎস? কত প্রাচীন তাঁর আরাধনার ঐতিহ্য? তিনি কি শুধুই জ্ঞানের দেবী? নাকি তাঁর আরও পরিচয় আছে? কি তাঁর আসল পরিচয়? শুধু কি সনাতন ধর্মেই তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়? নাকি অন্যান্য আরও অনেক ধর্মে তিনি দেবীর আসনে অধিষ্ঠাত্রী? শুধু কি বৈদিক, পৌরাণিক আর অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রেই তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়? নাকি তাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আর ঐতিহাসিক প্রমাণও আছে? হরপ্পা সভ্যতাই কি ভারতীয় উপমহাদেশের সব থেকে প্রাচীন সভ্যতা? নাকি তারও আগে কোন সুপ্রতিষ্ঠিত সভ্যতা ভারতবর্ষে ছিল? কি ছিল সেই প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তি? দীর্ঘ ষোল বছর ধরে প্রচুর গবেষণা করে এইসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও লেখক শ্রী অভীক গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সাধনার ফসল এই অসামান্য গ্রন্থটি। “সরস্বতী” বিষয়ক সমস্ত প্রেক্ষিতকে ধরে ধরে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি উন্মোচন করেছেন ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়কে। এই গবেষণায় লেখক প্রধানতঃ দু’ধরণের উৎসের সাহায্য নিয়েছেন―১) সাহিত্যিক উৎস আর ২) প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস। এই দুই উৎসের ক্ষেত্রেই পৃথক পৃথকভাবে উৎসগুলির সীমাবদ্ধতা এবং সেখান থেকে সেই সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করে কিভাবে তিনি যুক্তিপূর্ণ সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, সেকথাও তিনি বলেছেন। বৈদিক সাহিত্যে “সরস্বতী” কতরকম রূপে বিরাজমানা, সেকথাও প্রমাণসহ বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে, অভীকবাবুর গ্রন্থে। ঋগ্বেদ বর্ণিত বন্দনা স্তব “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী”-তে সরস্বতীর যে তিন রূপের উল্লেখ আছে, সেই তিনটি রূপকেই (মাতৃরূপা, নদীরূপা এবং দেবীরূপা) তিনি সমান গুরুত্বদিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। সারদা বা সরস্বতী লিপির কথাও উৎসতালিকা ও বর্ণমালা সহ উল্লিখিত হয়েছে এই গ্রন্থে। শুধুমাত্র বৈদিক সাহিত্যই নয়, বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগে, পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতেও বারবার উঠে এসেছে সরস্বতীর নাম। কখনো নদী রূপে, কখনো বা দেবী রূপে, আবার কখনো বা উভয়রূপেই। লেখকের কথায়, “১৮টি পুরাণের মধ্যে ১০টিতেই সরস্বতীকে একটি নদী বা দেবী বা উভয়রূপেই ব্যক্ত করা হয়েছে।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ৩৬)। তবে শুধু সরস্বতী সংক্রান্ত সমস্ত বৈদিক ও পৌরাণিক কাহিনীগুলিকেই সসূত্র বর্ণনা করেই অভীকবাবু থেমে থাকেন নি; তাঁর গ্রন্থে, “বিভিন্ন পৌরাণিক পাঠগুলিকে তুলনা করে সরস্বতী সম্বন্ধীয় মতবাদ ও পটশিল্পের বিকাশ নিয়ে আলোচনার করার প্রয়াস”-ও (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ৩৬) করা হয়েছে। এই সূত্র ধরেই গ্রন্থের পরবর্তী পর্যায়ে উঠে এসেছে সরস্বতীর নান্দনিক প্রেক্ষিত। সরস্বতীর বিগ্রহের বর্ণনা, রূপবিবর্তন, রূপবৈচিত্র্য, স্বকীয়তা, অনন্যতা সবকিছুরই প্রামাণ্য নথিসহ বিবরণ দিয়েছেন লেখক অভীক গঙ্গোপাধ্যায়। “বিভিন্ন গ্রন্থ সরস্বতীর প্রভূত মূর্তি ও বিগ্রহের আকার ব্যাখ্যা করে। তারা তাঁর দুইহস্ত বিশিষ্ট ও চার হস্ত বিশিষ্ট আকার বিভিন্ন মাধ্যম ও নিদর্শনের মধ্য দিয়ে উল্লেখ করেছে। তিনি একজন একক দেবী হিসেবে হয় উপবেশিত অথবা দণ্ডায়মান, আবার কখনও ব্রহ্মার পুত্রী ও স্ত্রী উভয়রূপেই সম্বোধন করা হয়েছে আর অন্যান্য সময় বিষ্ণুর একাধিক সহগামীর মধ্যে একজন রূপেও পুষ্টি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই সমস্ত গ্রন্থই তাকে একজন শ্বেতবর্ণ পবিত্র দেবী রূপে চিহ্নিত করতে সগোত্রীয় থেকেছে।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ৫০)। এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, বৃহদ ধর্মপুরাণ, তন্ত্রসার, সারদা তিলকতন্ত্র, বৃহদ সংহিতা, অংশুমদ ভেদাগমঃ, পূর্বকারণাগাম, বিষ্ণু ধর্মোত্তর পুরাণ, অপরাজিত গুচ্ছ, শিল্পরত্ন, রূপমন্দনা প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত সরস্বতীর বিভিন্ন রূপ। শুধু বৈদিক ধর্মেই নয়, অন্যান্য ধর্মে বর্ণিত সরস্বতীর বিভিন্ন রূপের উল্লেখ এই গ্রন্থে করা হয়েছে। “অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ধর্মগুলির মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মও এর ব্যতিক্রম ছিল না, বৌদ্ধদের বিশ্বাস ছিল দেবী সরস্বতী হলেন মঞ্জুশ্রী এবং প্রজ্ঞাপারমিতার অনুরূপ এক দেবী, যিনি প্রসন্না হলে সাধক মেধা, জ্ঞান, বুদ্ধি এমনকি বোধিজ্ঞানও লাভ করে থাকেন।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ৫৪)। বৌদ্ধধর্মে উল্লিখিত সরস্বতীর রূপগুলি হল―বজ্র-সরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী, বজ্রসারদা, মহাসরস্বতী, আর্যসরস্বতী, মহাময়ূরী, বাগেশ্বরী, আর্য জাঙ্গুলী প্রভৃতি। প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে জৈন ধর্মের কথাও। “জ্ঞান এবং বুদ্ধির দেবীরূপে সরস্বতীর স্থান বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের থেকে কোন অংশে কম নয়, তুলনামূলকভাবে বৌদ্ধদের থেকেই জৈনদের হৃদয়ের দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা অনেক গভীরভাবে নিহিত।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ৬৫)। জৈন ধর্মে সরস্বতীর বিভিন্ন রূপগুলির সম্পর্কে লেখক বলছেন, “জৈন ধর্মে জ্ঞানের দেবী সরস্বতী শ্রুতি, দেবতা, সারদা, ভারতী, ভাষা, বাক্, দেবতা, বাক্, বাগিশ্বরী, বাগ্বাদিনী, বাণী এবং ব্রাহ্মী নামেও প্রচলিত।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ৬৬)। এছাড়াও সরস্বতী সম্পর্কে প্রচলিত সব কিংবদন্তী, সরস্বতী মূর্তির সাংকেতিকতা, যোগের সাথে সরস্বতীর সম্পর্ক, সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠান ও উৎসব, দেবী সরস্বতীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত মন্দির, “সরস্বতী”-শব্দের নিরুক্তি, নদীরূপে সরস্বতীর সাথে ভারতের অন্যান্য নদ-নদীদের সম্পর্ক, সরস্বতীর শাখাপথ প্রভৃতিও বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, শুধুমাত্র সরস্বতীর এই মূর্তিগুলির বর্ণনা ও তার সাথে যুক্ত কিংবদন্তীগুলিকে আলোচনা করা ছাড়াও এই মূর্তিগুলি কোথা থেকে থেকে কিভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে, এখন কোথায় আছে, সেগুলির সম্পর্কেও লেখক যাবতীয় ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণেরও উল্লেখ করেছেন; আরও উল্লেখযোগ্য, এই মূর্তিগুলির প্রায় প্রত্যেকটিরই একটি করে ছবি এই গ্রন্থে সংযুক্ত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই সংযোজনগুলিতে গ্রন্থটি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে এবং স্বকীয়তা পেয়েছে। অভীকবাবু এ প্রসঙ্গে সরস্বতী বিগ্রহের ঘরানাগত পর্যালোচনা করার সময় উপবিষ্ট বিগ্রহ, দণ্ডায়মান বিগ্রহ ও নৃত্যরত সরস্বতী―এই তিন রূপকেই প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও নান্দনিক আঙ্গিকে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সাংস্কৃতিক-নৃতত্বে সরস্বতী কিভাবে নদী থেকে দেবীতে বিবর্তিত হলেন, সেটিও গুরুত্বসহকারে বিশ্লেষণ করেছেন। এবার এই গ্রন্থের সব থেকে উল্লেখযোগ্য অংশের কথা―সরস্বতী সভ্যতা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে যে তত্ত্বটি জনমানসে প্রচার করা হয়, সেটি হল “আর্য আক্রমণ তত্ত্ব”। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা এই ভিত্তিহীন তত্ত্বটি কিন্তু আজ প্রত্নতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে। যে যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই মিথ্যা তত্ত্বটিকে বারবার প্রশ্ন করছে, তাদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য―সরস্বতী নদী ও সেই নদীর তীরে গড়ে ওঠা নগর-সভ্যতা। অভীকবাবু তাঁর গ্রন্থে এই অধ্যায়টিকে “সরস্বতী সভ্যতাঃ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে কুয়াশাঘন ইতিহাস” নাম দিলেও, তিনি নিজেই এ প্রসঙ্গে এযাবৎ আবিষ্কৃত যাবতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নথী ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সাহায্যে কুয়াশা সরিয়ে সত্যের আলোর পথনির্দেশ করেছেন। প্রাচীনকালে কোন বিদেশী জাতি আক্রমণ আর গণহত্যা করে ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতি সৃষ্টি করে নি। আজ থেকে ৬০০০ বছর আগে সরস্বতী নদীর তীরেই (বর্তমান চেলিস্তান মরুভূমি) গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ভারতীয় নগর-সভ্যতা। “আমাদের বিভ্রান্ত করতে প্রচার করা হয় যে বিদেশীরা এসে ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। নদীর জন্যই ভারতে প্রস্তর যুগ থেকে সভ্যতার যুগে উত্তরণ সেকথা বলা হয় না।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ১৩০)। পরবর্তীকালে নৈসর্গিক কারণে সরস্বতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং ক্রমে সরস্বতী নদীর মৃত্যুর ফলেই সরস্বতী সভ্যতার মানুষেরা বাধ্য হয়ে আরও পূর্বে সরে আসেন। এই প্রসঙ্গেও শুধু গবেষণাগ্রন্থগুলিতে বৈজ্ঞানিক আর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উল্লেখের পাশাপাশি গ্রন্থে সংযুক্ত হয়েছে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংস্থা (যেমনঃ ইসরো) থেকে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় উপগ্রহ চিত্র, যা গ্রন্থে আলোচিত বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলিকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইংরাজিতে সরস্বতী নদী, সরস্বতী সভ্যতা এবং সরস্বতীর অন্যান্য প্রেক্ষিত নিয়ে বেশ কিছু বই আছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় আজ পর্যন্ত এই নিয়ে সেইভাবে কোন উল্লেখযোগ্য কাজ তেমন কিছুই হয়নি। যেটুকু যা হয়েছে, সেটুকুও মূলতঃ সরস্বতী পূজার দিকটি নিয়েই। কিন্তু তার বাইরেও বৈদিক, পৌরাণিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও নান্দনিক প্রেক্ষিতের এত বড় পরিসরে সরস্বতী নিয়ে বাংলা ভাষায় এইরকম কোন কাজ এই প্রথম। সেই দিক গ্রন্থের লেখক অভীক গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনন্দন অবশ্যই প্রাপ্য। বাংলা ভাষায় ভারততত্ত্ব বিষয়ের চর্চার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। সাধারণ পাঠক থেকে ভারততত্ত্ব বা ইতিহাসে আগ্রহী পাঠক, সকলেই এই বইটি পড়ে সমৃদ্ধ হবেন, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। সংস্কৃতে একটি কথা আছে “মধুরেণ সমাপয়েৎ।” সঙ্গীতের থেকে মধুর আর কিই বা হতে পারে। অভীকবাবুও তাঁর এই এত তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটিও শেষ করেছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম রাগ, “রাগ সরস্বতী”-র উল্লেখ করে। সঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে স্বরলিপি ও রাগের বিস্তারের রূপরেখাও। গ্রন্থের একদম শেষ বাক্যটি হল, “ওস্তাদ রশিদ খান-এর এই রাগের ওপর একটি খেয়াল আছে।” (সরস্বতী/পৃষ্ঠাঃ ১৪৬)। সেই সূত্র ধরে আমরাও সবার শেষে বলি, রশিদ খান-এর গাওয়া সরস্বতী রাগের ওপর সেই খেয়ালটি আমাদের কানে বাজতে থাকুক, আর কালকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ হয়ে থাকুন ভারতী উপমহাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রকৃত জননী―“সরস্বতী”।