বাংলা

‘নিরর্থক প্রহসনের ইতি’ : ভারজিনিয়া ওল্‌ফ, প্রাবন্ধিক :অভীক গঙ্গোপাধ্যায়

                  প্রবন্ধ সংকলন “বিষয় আত্মহনন” , ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ

 

পূর্বকথা

ভাষাবন্ধন শিল্প-সাহিত্য-সমালোচনা  সিরিজের বিষয় আত্মহনন  গ্রন্থে আমার যে দুটি  প্রবন্ধ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এই প্রবন্ধটি তার একটি।

 

 

প্রাবন্ধিক :অভীক গঙ্গোপাধ্যায়

 

‘নিরর্থক প্রহসনের ইতি’ :  ভারজিনিয়া ওল্‌ফ

“If you do not tell the truth about yourself you cannot tell it about other people.”

বেলা সাড়ে এগারোটার সময় সাসেক্স-এর বাড়ির গা ঘেঁষে যাওয়া আউসে নদীর পথে ঊনষাট বছরের স্থির ব্যক্তিত্বের দৃপ্ত ভঙ্গিতে একটি লাঠি হাতে এক মহিলার হেঁটে যাওয়া চোখে পড়ছিল অনেকেরই।চেনা মুখ,হাতে সেই পরিচিত লাঠি, দিনটা ১৯৪১-এর ২৮ মার্চ।বাড়ি ছেড়ে বেরোবার সময় রেখে গেছেন একই বয়ানের দুটি চিঠি।একটি দশদিন আগের লেখা বোন ভানেসা-কে।আর একটি একটু আগেই শেষ করা,স্বামী লেওনার্দকে।চিঠিতে লেখা :

‘প্রিয়,আমি নিশ্চি ত,আবার আমি ভারসাম্য হারাচ্ছি।আমি অনুভব করি যে আর একবার ওইরকম বীভৎস সময়ের মধ্যে দিয়ে আর আমাদের চলা সম্ভব নয়।আর এবার আর আমি সেরে উঠবো না।আমি মনঃসংযোগ করতে পারছিনা নানারকম কথা শুনতে শুরু করেছি।তাই যা সব থেকে গ্রহণযোগ্য তাই আমি করছি।সব সম্ভাব্য সুখ তুমি আমায় দিয়েছ।একজনের যা হওয়া উচিত সব দিক থেকেই তুমি তাই।এই বীভৎস রোগ আসার আগে আমার মনে হয় না দুজন মানুষের জীবনে সুখের কোনও অভাব ছিল।আমি আর লড়াই করতে পারছিনা।আমি জানি যে আমি তোমার জীবনটাই নষ্ট করেছি,এও জানি যে আমার অবর্তমানে তুমি কাজ করে যেতে পারবে।আমি জানি তুমি পারবে।দেখছ, আমি এটাও গুছিয়ে লিখতে  পারছিনা।আমি পড়তে পারিনা।আমি এইটুকুই বলতে চাই যে আমার জীবনের সব সুখের ঋণ তোমার কাছে।তুমি যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছ এবং আমার প্রতি এত বেশি ভাল ছিলে....সবাই এটা জানে তাও আমি বলতে চাই।যদি কেউ আমাকে বাঁচাতে পারত,সে তুমি।সবকিছু আজ আমাকে ছেড়ে গেলেও তোমার ভালবাসার নিশ্চয়তা অটুট।এভাবে আমি তোমার জীবন নষ্ট করতে পারিনা।আমার মনে হয়না আমাদের দুজনের মতো এতো সুখী কোনও দুজন মানুষ দেখি’।  

 

 

কুড়ি দিন পরে ১৮ই এপ্রিল একদল বাচ্চা আউসে নদীতে নিখোঁজ এই বিশ্বখ্যাত মহিলার মৃতদেহের খোঁজ দেয়। ভারী বড়ো কোট, প্রতিটা পকেটেই ভারী পাথর-- স্বামী লিওনার্দ দেহটি শনাক্ত করেন--তার স্ত্রী ভার্জিনিয়া ওল্‌ফইংরেজ ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক,পত্রসাহিত্যিক, প্রকাশক,গল্পকার ও বুদ্ধিজীবী, নারীবাদী, বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সাহিত্যের আধুনিকতার প্রবক্তাদের অগ্রজ ভার্জিনিয়া ওল্‌ফের জীবনের শেষটাও স্বরচিত।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তী সময়ের লন্ডনের সাহিত্য সমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব, ‘ব্লুমস বেরি গ্রুপ’-এর অন্যতম সদস্যা ভার্জিনিয়া ওল্‌ফকে নিয়ে একদিকে সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে যেমন অস্বস্তি ছিল, অন্যদিকে মৌলিক প্রতিভাধর ঔপন্যাসিক কবি ও নাট্যকারদের কাছে এরকম আঙ্গিকের পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ শিল্পীর বুদ্ধিদীপ্ত সান্নিধ্য ও উপস্থিতি অনুসরণীয় ছিল। টি.এস.এলিয়ট উৎসাহ দিয়ে লিখেছিলেন তাঁর এই বান্ধবীকে, ...you have freed yourself from any compromise between the traditional novel and your original gift…..’

প্রথম নজরে মৌলিকতাকে চিনতে পারার অক্ষমতা সর্বজনীন, তীক্ষ্ণ সমালোচনায় প্রথাবহির্ভূত বিষয় বা রচনাশৈলির সীমা লঙ্ঘন করা যে চিরকালই প্রশ্রয় পায় না,  ১৯২২ সালে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক জন মিডিলটন মারে’র আক্রমণাত্মক প্রবন্ধ তারই নিদর্শন ছিল। তবে বিরূপ সমালোচনা বা স্বীকৃতির অভাবে যেভাবে বহু স্রষ্টার সত্তাকে ও জীবনকে আত্মহননের দিকে নিয়ে গেছে, ভার্জিনিয়া ওল্‌ফ সেই শ্রেণীভুক্ত ননপ্রায় ১৮টি প্রকাশিত গ্রন্থের লেখক (‘লেখিকা’ শব্দটি ইচ্ছাকৃত ভাবেই বাদ দিলাম), সমাজসংস্কারক লেখক ও ফেবিয়ান স্বামী লিওনার্দ ওল্‌ফের স্ত্রী, প্রি-র‍্যাফায়লাইট চিত্রকরদের পছন্দের মডেল অসাধারণ রূপসী জুলিয়া প্রিন্সেপ স্টিফেন-(১৮৪৬-১৮৯৫) এরও প্রতিষ্ঠিত লেখক,সমালোচক,জীবনীকার ও পর্বতারোহী স্যার লেসলি স্টিফেন এর কন্যা--সাধারণ মনোরোগের স্বীকার হবার কোনো উপাদান নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি ও বড়ো হয়ে ওঠেননি। ভিক্টোরিয় সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বড়ো হয়ে ওঠা ভার্জিনিয়া ওলফ্‌-এর অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সামাজিক ভিত্তির ওপর ইংরেজি উপন্যাস প্রতিষ্ঠিত ছিল তার ভিত্তিকে আঘাত করার ক্ষমতা ছিল।তাই ভাগ্য, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে মানুষের অবস্থান, সামাজিক সম্পর্কের সাফল্য-অসাফল্য যে ভিক্টোরিয় উপন্যাসের বৃত্ত ছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক উপন্যাসের নামে যে উপন্যাস রচিত হচ্ছিল, তা যে যথার্থ আধুনিক নয়, লিখিত প্রবন্ধের মধ্যে দিয়েই এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতির স্বীকৃতি তাঁর জীবনে প্রথম ঘটে। ১৯২৩ সালে লিখিত ও ১৯২৪-এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধে-‘মিস্টার বেনেট অ্যান্ড মিসেস ব্রাউন’-এ ওল্‌ফ লেখেন যে ১৯১০ সালে সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর একটা পরিবর্তন এসেছে সাহিত্যিক বাস্তবতার দিকে, কিন্তু সেই বাস্তবতা বা বস্তুমুখীনতা এডওয়ার্ডীয় ঔপন্যাসিক আরনল্ড বেনেট (১৮৬৭-১৯৩১),জন গল্‌সওয়ার্দি (১৮৬৭-১৯৩৩) ও এইচ.জি.ওয়েলস (১৮৬৬-১৯৪৬)এদের মতো ‘materialists’-দের বাহ্যিক বাস্তবতার অনুপুঙ্খ চিত্রণ নয়। ১৯১৯ সালে লিখিত ‘মডার্ন ফিকশন’ প্রবন্ধের উপাদানও এই প্রবন্ধে ফিরে আসে, যেখানে তিনি নিজেকে আরেকজন সমমনোভাবাপন্ন আধুনিক লেখক, জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪২) এর সঙ্গে তুলনা করেন--দুজনেরই একই সাধারণ প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে বলেন যে উভয়েই ভাবনা ও অনুভূতির চড়াই উৎরাই ধরে চলেছেন, যা পড়তে গেলে এক মনস্তাত্ত্বিক স্বরলিপির প্রয়োজন, আর যা লিখতে গেলে পুরনো ঔপন্যাসিকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক নতুন কথন প্রকরণ বা বাক্য বিনির্মাণের প্রয়োজন। ভার্জিনিয়া ওল্‌ফের ভাষায় এই  অন্তর্বাস্তবতা, ‘a look within the lifeতাই তার লেখা উপন্যাসে বাদ পড়ল প্রথাগত প্লট, কথক ও কথন, কেন্দ্রীয় চরিত্র, নিয়মিত ভাবে আসা নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনা। সেই জায়গায় এলো মানব চেতনা-প্রবাহের ব্যক্তিগত অনুভূত মুহূর্তের ভাষ্য, যাকে মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার শেষ কথা বলে সমকালীন বুদ্ধিদীপ্ত ও আধুনিক মননধর্মী রসিক পাঠক চিহ্নিত করতেন।